পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
18

গোলন্দাজ বাহিনী আমাদের সহযোগিতা করবে। সীমান্তবর্তী এলাকা এবং সীমান্ত ফাঁড়ি দখল পরিকল্পনার পেছনে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিলো, সেগুলো হচ্ছেঃ

 (ক) এইসব সীমান্ত ফাঁড়ি বা সীমান্ত এলাকা দখলের যুদ্ধে আমাদের বাহিনীর দক্ষতা ও দুর্বলতা আমরা নিরূপন করতে পারবে।

 (খ) সকলকে বুঝিয়ে দেয়া যে, লক্ষ্য অর্জনে আমরা বদ্ধপরিকর। এবং আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। এতে করে শত্রুরা গেরিলাবিরোধী তৎপরতা কমিয়ে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থায় আরো বেশী শক্তি নিয়োগ করবে। শত্রুদের এভাবে সীমান্ত এলাকায় ব্যস্ত রাখতে পারলে দেশের অভ্যন্তর ভাগে শত্রুর সংখ্যা কমে যাবে, ফলে গেরিলাদের কাজ করা আরো সহজ হবে।

 (গ) এ ধরনের সংঘর্ষের মাধ্যমেই শত্রুর প্রস্তুতি এবং তার প্রতিরোধ ক্ষমতার মাত্রাও আমরা পরিমাপ করতে পারবো।

 সীমান্তরেখা বরাবর আমাদের তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানীরা ঠিকই অভ্যান্তর ভাগের শক্তি কমিয়ে সীমান্তে এনে সৈন্য জড়ো করতে থাকে। এতে বিভিন্ন স্থানের পরিস্থিতি গেরিলাদের অনুকূল হয়ে ওঠে। অবশ্য, এই সঙ্গে কিছুটা অসুবিধাও দেখা দেয়। সীমান্ত এলাকায় শত্রুর শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের সেই পথ দিয়ে দেশের ভেতরে পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ভেতরে প্রবেশের প্রায় সকল পথই শত্রুসৈন্যরা বন্ধ করে দেয়।

 ২২শে সেপ্টেম্বর চম্পকনগর সীমান্ত ফাঁড়ি এবং প্রধান সড়কের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বল্লভপুর এলাকা দখল করার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালাই। আক্রমণের আগে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী লক্ষস্থলের ওপর গোলাবর্ষণের মাধ্যমে শত্রুর সুদৃঢ় অবস্থানগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করে।

 কিন্তু দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমরা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হই। কামানের গোলায় শত্রুর তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানীদের বাংকারগুলো ছিলো খুব মজবুত। প্রতিটি প্রতিরক্ষা বাংকারেই শত্রুরা ভূগর্ভে কয়েকদিন থাকার মতো রসদপত্র মজুত করে রেখেছিলো। ঘাঁটিগুলোর মধ্যে আবার গভীর ট্রেঞ্চপথে যোগাযোগ ছিলো। তাছাড়া আমরা যা অনুমান করেছিলাম তার চাইতেও বেশী ছিলো তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সম্ভার।

 চম্পকনগর সীমান্ত ফাঁড়ি আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো ক্যাপ্টেন মাহফুজকে। ফাঁড়ির ডান পাশ দিয়ে নিজেদেরকে আড়াল করে আমি ওদের অগ্রসর হবার নির্দেশ দেই। কিন্তু লক্ষ্যস্থলের চারপাশে কয়েকশ' গজ এলাকায় গা ঢাকা দেয়ার মত তেমন কোন ফসলের ক্ষেত, উঁচু ভূমি অথবা বন-জঙ্গল ছিলো না। পার্শ্ববর্তী একটি পাহাড় থেকে আমি যুদ্ধ পরিচালানা করছিলাম। ফাঁড়িটি থেকে এর দূরুত্ব ছিলো আটশত গজের মত। সেখান থেকে আমি লক্ষ্যস্থলের অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম। অয়্যারলেসে মাহফুজ আমার সাথে যোগাযোগ রাখছিলো। আমাদের বাহিনীর 'কভার' দেয়ার জন্য কামানসহ ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনীর একজন পর্যবেক্ষকও আমার সাথে ছিলেন। আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের সৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার আগে কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। কামানের গোলাবর্ষণ শেষ হলে আমাদের বাহিনী চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় শত্রুরাও প্রচণ্ড বেগে গুলীবর্ষণ শুরু করে। ফাঁড়ির হান এবং বাম উভয় পার্শ্ব থেকেই একটি করে মেশিনগান আমাদের 'কোম্পনীকে' যথেষ্ট বিপাকে ফেলে দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে মাহফুজের একমাত্র অয়্যারলেস সেটটিও তখন বিকল হয়ে পড়ে। একটির বেশী দেবার মত মজুত কোন সেট আমাদের ছিলো না। অয়্যারলেস সেট নষ্ট হতেই মাহফুজ তার প্লাটুনের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে এবং আমার ও মাহফুজের মধ্যকার সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই শুভপুর সেতুর দিক থেকে পাকিস্তানীদের কামানের গোলা আমাদের ওপর এসে পড়তে থাকে। এদিকে করেরহাট এলাকা থেকে আরো শত্রুসৈন্য দ্রুত চম্পকনগর এসে পৌঁছায়।