পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
408

 একজন লিডার নিয়ে চারজনসহ এক একটা দল। লিডারদের আমরা ক্যাবিনের ভিতর ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ ও কিছু টাকা পয়সা দিলাম- যেন পথে ওরা খাদ্যের জন্য কষ্ট না পায়। সবই প্রস্তুত। কিন্তু ঝড়ের দাপট প্রশমিত হবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। এই ঝড়ের মধ্যে ওদের কে পাঠানো আমি সমীচীন মনে করলাম না। কাজেই কাজটা রাত্রের মত স্থগিত রইল এবং ১১ তারিখ খুব ভোরে ওদের যাত্রা করতে দিলাম। এই মোশাররফ পথ দেখিয়ে আমাকে ভারতে পৌঁছে দেয়। সে সুন্দরবন এলাকার মুন্সিগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা। সবার মুখেই হাসি। সবাই খুশী। শেষ বারের মত সবাইকে উপদেশ দিয়ে এবং ওদের মংগল কামনা করে ওই রাত্রেই আমরা হাসনাবাদ রওনা হলাম। আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ঠিক তিনদিন পরেই অর্থাৎ ১৪ই সেপ্টেম্বর ভোরে ওরা নিরাপদে ঠিকমত জায়গায় পৌঁছে গেল।

 ১৫ই সেপ্টেম্বর সামনে। শত্রুর উপর চরম আঘাত হানার মাহেন্দ্রক্ষণ। যে জায়গা থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা হবে তার সাথে সংযোগ সাধন, আক্রমণের পর যেখানে গিয়ে সবাই জমা হতে হবে সেখানে গেরিলাদের ঠিকমত জায়গায় রাখা, উদ্দেশ্য সমাধা করার পর সবাইকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় রাখা উদ্দেশ্যে সমাধা করার পর সবাইকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে পড়া- ইত্যাদি প্রাথমিক কাজকর্ম সম্পন্ন করার জন্য হাতে খুব কম সময়ই আছে। ১৪ তারিখ ভোর থেকে ১৫ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত ওদের প্রস্তুতি নিতে কেটে গেল। হাবিলদার আফজাল ও খিজিরের স্থল- গেরিলারা ওদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা লোভাতুর চোখে চেয়ে দেখলো আটটি বানিজ্যিক জাহাজ চালনা বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে। পশুর নদীর মাঝখানে সবগুলো নোংগর করা। ঠিক হলো 'জোড়া পদ্ধতিতে' আক্রমণ চালাতে হবে- অথাৎ দু'জন ফ্রগম্যান এক- একটি জাহাজকে আঘাত করার জন্য এক-একজন ফ্রগম্যানের কাছে চারটি করে, দু'জনার কাছে মোট আটটি লিম্পেট মাইন' থাকবে। লিম্পেট মাইন পানিতে ভাসে। সুতরাং ওদের পক্ষে এতগুলো মাইন এক সংগে বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ হলো। ঘাঁটি থেকে প্রায় পনেরশ' গজ দূরে জাহাজগুলো এলোমেলো অবস্থায় নোংগর করা। ১৫ই সেপ্টেম্বরের সারাটা দিন কেটে গেল ওদের সবকিছু বুঝিয়ে দিতে। এক-একটা জাহাজ আক্রমণ করার ভার এক একটা দলের উপর ন্যস্ত করা হলো।

 ষোলজন ফ্রগম্যান নিয়ে আটটি দল। ওরা আক্রমণ করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। প্রথম অভিযান ব্যর্থ হলে বাকী চৌদ্দজনকে পরবর্তী পর্যায়ে আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য রিজার্ভ রাখা হলো। আঘাত করার সময় নির্ধারিত হলো রাত সাড়ে চারটা। সাধারণতঃ এই সময়েই পাক হানাদাররা বিরক্তি ও ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়ে। আর যারা ঘুমিয়ে থাকে, একই সঙ্গে তারা আরও বেঘোরে ঘুমাতে থাকে। স্থির হলো একই সংগে আটটি জাহাজের উপর হামলা চালাতে হবে।

 রাত আড়াইটা। খুব আন্ধকার। বাইরে ঝড়ের দাপাদাপি। দমকা বাতাসের চাবুক খেয়ে পিছন দিকের অরণ্যটা আর্তনাদ করে উঠলো। অধিনায়ক মিঃ আসাদুল্লাহ ছেলেদের কানে কানে বললো, আঘাত করার এইতো উপযুক্ত সময়। সতর্কতার সাথে শেষবারের মত আবার সে সবাইকে পরীক্ষা করে নিলো। এখন থেকে মাত্র দু'ঘণ্টা পরে সমস্ত নদীর বুক জুড়ে তরংগায়িত হবে বলে টকটকে উত্তপ্ত রক্তস্রোত। নদীর অপর পাড়ে শত্রুপক্ষ নিশ্চিন্ত। কেননা ওরা ভাবতেই পারেনি অলস বাঙ্গালীরা ওদের পায়ের তলায় কোনদিন আঘাত হানতে পারবে। নদীতে হিংস্র জীবজন্তু আছে জেনেও দুর্যোগময় এই ঝড়ের মাঝরাতে প্রমত্তা নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। মৃত্যুভয়কে দূরে ঠেলে দেশপ্রেমের জলন্ত বহ্নিশিখা বুকে নিয়ে ওরা ষোলজন সবাই একসংগে দুটো পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুখে লেশমাত্র ভীতির চিহ্ন নেই। আত্মপ্রত্যয়ের মহান আদর্শে উদ্ভাসিত। বেয়াড়া প্রকৃতির রক্তচক্ষুকে ভয় না করে মুক্তিযোদ্ধারা নদীর বুক চিরে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো লক্ষ্যবস্ত্তর দিকে। ওদের কোমল ডানাগুলো ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়লো। কিন্তু জলের উপর ভেসে ভেসে ঢেউয়ের কোলে মাথা রেখে ওরা লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে পৌঁছলো। সাড়ে চারটা বাজতে এখনও পাঁচ মিনিট বাকি।