এই আক্রমণের মোটামুটি ফল হলো- এইসব জায়গায় শ্রমিকরা সবাই পালিয়ে জান বাঁচলো। ডিসেম্বরে দেশ মুক্ত হবার আগ পর্যন্ত ওরা আর ফিরে এলোনা। এই ঘটনার পর,এমনকি কোন বিদেশী জাহাজও বন্দরে নোংগর করতে রাজী হতো না। আমরা এটাই চেয়েছিলাম।
বিজয় অভিযান
বিজয় অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা শুধুমাত্র নীরব দর্শকই ছিল না। তাদের একটা নির্দিষ্ট ও উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা অবলম্বন করতে হয়েছিল। এই তৎপরতা নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এরপর টাকি থেকে একশো পঞ্চাশ মাইল দূরে কৃষ্ণনগরে চার্লি সেক্টরে একটা কনফারেন্সে যোগদান করার জন্য আমাকে ডাকা হয়। চার্লি সেক্টর এই সময় ব্যারাকপুর থেকে কৃষ্ণনগরে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার এন, এ,সাকিলও ওই সম্মেলনে উস্থিত ছিলেন। ভারত জরুরী অবস্থা ঘোষণা করলে কিভাবে আমাকে সামনে অগ্রসর হতে হবে, এ ব্যাপারে তিনি মোটামুটি একটা ধারণা দিলেন। মিত্রবাহিনীর পরিকল্পনার কথা গোপন রেখে সাতক্ষীরা- দৌলতপুর রোডে এবং আরও দক্ষিণে আমার লোকজন নিয়ে যে - কোন সময় আগ্রসর হবার জন্য তিনি আমাকে প্রস্তুত ও সতর্ক থাকতে বললেন। পরিকল্পনার কথা আমাকে না জানালেও আমি অনুমান করলাম যে, সাতক্ষীরার বাঁ দিক থেকে একটা সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে সাতক্ষীরা- দৌলতপুর বরাবর শত্রু ঘাঁটিগুলো নিশ্চিহ্ন করার জন্য যশোরের উত্তর দিক থেকে প্রধান আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। তাছাড়া, আমারা মুক্তিযোদ্ধারা পাক-বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর গোলাবর্ষণের মাঝখানে পড়ে যাতে বিপর্যস্ত না হয়, সেই জন্য মিত্রবাহিনীর আগে আমার সৈন্যবাহিনী পাঠাতে বারন করা হলো। আমাকে জানানো হলো যে, মিত্রবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য হবে এইরূপঃ প্রথমত, সময়মত মিত্রবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় লোকজন দেয়া। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর মিত্রবাহিনী কোন প্রশাসনিক অসুবিধার সম্মুখীন হলে তা দূর করার জন্য তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। তৃতীয়ত, ঘনিষ্ঠভাবে মিত্রবাহিনীকে অনুসরণ করা এবং তাদের সংস্পর্শে থাকা। আমাকে বলা হলো যে, যেহেতু ‘বাংলা অঞ্চল’(বেঙ্গল এরিয়া-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি) আমার নিকটবর্তী, সেই জন্য আমার সেক্টর এখন থেকে বাংলা অঞ্চলের প্রশাসনিক আওতাধীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণ সুন্দরবন এলাকার সম্পূর্ণ জলপথ বাংলা অঞ্চলের অধীনে এনে,এর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় জেনারেল পি, কে, রায় চৌধুরীর উপর।
সেক্টরে ফিরে আমি আমার নিজস্ব পরিকল্পনা তৈরী করলাম। আবার দুই হাজার গেরিলা সৈন্য ছিল। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র খুবই অপ্রতুল। তবুও আমি মনে করলাম যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলাদের উপস্থিতিই অনেকটা প্রভাব কিস্তার করবে। কেননা, বিজয় অভিযানের সময় সম্ভাব্য রাহাজানি, ধর্ষণ ও অন্যান্য অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে ঘটতে না পারে সেদিকে আমার লোকজন সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারবে। কাজেই, পরপর দুরাত্রিতে আঠারোশো গেরিলা সৈন্যকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। বাদবাকী গেরিলাদের বিজয় অভিযানের সময় অগ্রসর হওয়ার জন্য অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত করে রাখা হলো। সদর দপ্তরে ও আমার সেক্টরের অন্যান্য জায়গায় আমার নিয়ন্ত্রণাধীনে যেসব সৈন্য মোতায়েন ছিল, তাদের সদা সতর্ক থাকতে বলেছিলাম। আমার সেক্টর সদর দপ্তরের বিস্তৃতি অনেক দূর পর্যন্ত। অল্প সময়ের নোটিশে এটা গুটিয়ে আনা সম্ভব নয়। আমি ফ্লাইট সার্জেণ্ট ফজলুল হককে বুঝিয়ে বললাম যে, যে সমস্ত আর্মিরা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে হাজির হতে পারবে না, তারা যেন দেশ মুক্ত হওয়ার পরই খুলনায় আমার সাথে মিলিত হয়। হিসাবপত্র ঠিক রাখা এবং মুক্তিদ্ধোদের প্রতি যত্ন নেয়ার জন্যও সার্জেণ্ট ফজলুল হককে নির্দেশ দিলাম। কেননা, আমরা চলে গেলে যেসব মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্যান্য যুবক এখানে এসে হাজির হবে তারা নিতান্ত অসুবিধায় পড়বে।
সৌভাগ্যক্রমে দ্বিতীয়বারের মত লেঃ জিয়া এসে গেল। সুন্দরবন এলাকায় সে পাকিস্তানী গানবোটের সামনে শত্রুপক্ষের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে তার অঞ্চলকে সম্পুর্ণরূপে মুক্ত করেছে হানাদাররা নদী বরাবর তাদের