পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
412

 আনন্দ-উত্তেজনায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললাম। ক্যাপ্টেন হুদা মুক্তিযোদ্ধদের নিয়ে বসন্তপুর, কালিগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জে শত্রুর অবস্থানের উপর চরম আঘাত হেনে এই ঘটিগুলো আমাদের কব্জায় এনেছে। কি ভয়ংকর উত্তেজনা। ক্যাপ্টেন হুদা কথা বলতে পারছিল না। তার বাক রুদ্ধ হয়ে এলো। উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যের অফুরন্ত আনন্দে আমরা সবই বিস্ময়াভিভূত, হতবাক। হুদা ও তার সাথের মুক্তিসেনাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন জানালাম। বললাম যে, শত্রুর উপর আঘাতের ক্ষিপ্রতা ও তার গতিবেগ যেন পুরোপুরি রক্ষা করা হয়। আনন্দ ও উত্তেজনায় এতটা আত্মহারা যে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এই পবিত্র দিনটিতে বহু প্রতীক্ষিত বিজয় অভিযান শুরু হলো। স্কুল শিক্ষক মিঃ শাহজাহানকে পারুলিয়া রোডের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলাম। কেননা বসন্তপুর ও কালিগঞ্জ ঘাঁটি থেকে শত্রুবাহিনীকে এই পথ দিয়েই পালাতে হবে এবং এটাই একমাত্র পাকা রাস্তা। একই সংগে মিং চৌধুরীর নেতৃত্বে ষাটজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে পারুলিয়া ব্রীজটা অক্ষত অবস্থায় অধিকার করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। মিঃ চৌধুরী পাকিস্তান নৌবাহিনীর একজন অভিজ্ঞ নাবিক। বেশ হাসিখুশী। কঠোর প্রকৃতির এই মানুষটি আমার পরিকল্পনায় খুশী হয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিলো।

 প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়ার পর আমি মোস্তফাকে নিয়ে স্থানটা স্বচক্ষে দেখার জন্য বসন্তপুরের দিকে রওনা হলাম। দীর্ঘ ন'মাস যাবৎ ইছামতির ওপার থেকে বসন্তপুর আমাদের কতবার ইশারায় আহবান জানিয়েছে। এক ঘণ্টা পরে হিংগলগঞ্জে পৌঁছে দু'জন স্পীডবোট নদী পার হয়ে তীরে নামলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার আজ কোন মেশিনগান গর্জে উঠলো না। আগে অবশ্যই কোন অতিথির পদার্পণ মাত্র মেশিনগানগুলো মুহুর্তে এক ঝলক আগুন ছুড়ে গর্জে উঠতো।

 রক্তলাল সূর্যটাকে বুকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা যখন পত্ পত্ করে উড্ডীন দেখলাম, তখন কি যে উত্তেজনা! ওই সূর্যটাকে স্বাগত জানাতে কত না রক্ত ঢালতে হয়েছে এই ইছামতির তীরে। সমুন্নত পতাকার নিচে দু’থেকে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা নীরবে দণ্ডায়মান। শত্রুর কোন চিহ্ন নেই। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, রেশন এবং চারিদিকে কুৎসিৎ ধ্বংসাবশেষ রেখে হানাদাররা পালিয়েছে।

 স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াবার জন্য আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল অনেক মুক্তিপাগল তরুণকে। ওদের মহান আত্মত্যাগের জন্যই আজ স্বাধীন বাংলার পতাকা সমুন্নত শিরে উড্ডীন রয়েছে। পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র দেখে আজ আর আমি উত্তেজিত হই না। আগে মাত্র একটা রাইফেল দেখে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। এখন এটা আমার কাছে অস্বস্তিকর লাগলো।

 বসন্তপুর অধিকার করে আনন্দ ও উত্তেজনার পরিবর্তে মন আমার বেদনাভরাক্রান্ত হয়ে উঠলো। নভেম্বরের শীতল বাতাসে উঁচু বাঁধটার উপর দাঁড়িয়ে মানুষের এই বীভৎস কংকাল গুলোর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। কি মর্মান্তিক! ওরা রক্ত দিয়েছে, আমরা ও রক্ত দিয়েছি। সাক্ষী রয়েছে ওদের কংকালগুলো। স্বাধীনতা-পাগল আমার মুক্তিযোদ্ধাদের কংকালও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এখানে-ওখানে।

 এই মিশ্র অনুভূতি সম্বল করে কালিগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জ পরিদর্শন করলাম। এই জায়গাগুলো কিছু ভাল বলে মনে হলো। কিছুটা প্রাণের স্পন্দন এখনও যেন বেঁচে আছে।

 এখানে কিছু লোকজন দেখলাম। অনেক বাড়িঘর ধ্বংস্তুপের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আবার অনেকগুলো নারকীয় অগ্ন্যুৎসবের বিকলাংগ চেহারা নিয়ে বীভৎসতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত দুঃখের মাঝেও যে ক'জন লোক আমরা এখানে পেয়েছিলাম, তারা আমাদের স্বাগত জানাতে কার্পণ্য করলো না। স্থানীয় লোকজন বললো, গত রাত থেকেই হানাদাররা সাততাড়াতাড়িতে পালাতে শুরু করেছিল পলায়নপর হানাদারদের স্থানীয় লোকজন যখন জিজ্ঞেস করেছে আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? তখন ওরা কম্পিত স্বরে জবাব দিয়েছিল, মুক্তিরা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, ওপরওয়ালাদের হুকুমমত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি।'