পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
413

ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হানাদাররা যে ভাবে পালিয়ে গিয়েছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয় লোকজন হাসিতে ফেটে পড়লো। অনেক দামী ও লোভনীয় জিনিস রেখে যাওয়া ছাড়াও হানাদাররা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নদীতে ফেলে দেয়।

 ক্যাপ্টেন হুদা রাতে বসন্তপুরের উপর আক্রমণ চালায়। জবাবে সারা রাত ধরে হানাদাররাও প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। আর এই গোলাবর্ষণের আড়ালে রাতের আধাঁরে গা-ঢাকা দিয়ে শত্ররা পালিয়ে যায়। ভোরে অবস্থা অত্যন্ত শান্ত ভাব ধারণ করায় হুদা, মুক্তিযোদ্ধার একটি ছোট দলকে গ্রামের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে, যারা আমদের গোপনে সংবাদ সরবরাহ করতো, তাদের কাছ থেকে প্রথমে জানতে পারলো যে, হানাদাররা পালিয়ে গেছে।

 সংবাদ পেয়ে হুদা এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে কালিগঞ্জ-সাতক্ষীরা রাস্তা ধরে একরকম দৌঁড়ে বসন্ত পুরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। একটা ভাঙ্গা জীপ ছাড়া তার সাথে আর কোন যানবাহন ছিল না। জীপটা কিছুদিন আগে হানাদারদের কাছ থেকে অধিকার করা হয়। হানাদাররা তখনও পালাচ্ছিল। প্রশংসনীয় উদ্যম ও মনোবল নিয়ে ক্যাপ্টন হুদা দীর্ঘ বারো মাইল পথ হেঁটে তার বাহিনীসহ মিঃ শাজাহানের লোকদের কাছে পৌঁছে হানাদারদের সম্মুখ থেকে আঘাত হানলো, তখন ওরা দিশেহারা হয়ে পারুলিয়ার দিকে পালাতে শুরু করে। ওদিকে মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বে টাকি থেকে যে সৈন্যদলটি এসেছিল, তারা পলায়নপর হানাদার বাহিনীর একটি দলকে মাঝপথে অবরোধ করে ফেললো। এদিকে হুদা জানতে পারলো যে, হানাদাররা পারুলিয়া সেতু উড়িয়ে দিয়ে ওপারে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সেতুর চার মাইল দুরে অবস্থান নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা দ্রুত মিঃ চৌধুরী ও শাজাহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীকে তার লোক জনদের একত্র করে পুনর্বিন্যাস করলো।

 সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে আটটি কোম্পানীতে বিভক্ত করে লেঃ মোহাম্মদ আলী, লে আহসানউল্লাহ, লেঃ শচীন্দ্র ও মিঃ চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়ে রাতের অন্ধকারে ব্রীজের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। হানাদাররা পালাবার আগেই ব্রীজের ওপারে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে নিয়েছিল তাছাড়াও ব্রীজের চার মাইল পিছনে আলিপুর নামক একটি জায়গায় তাদের একটি শক্তিশালী আর্টিলারী রেজিমেণ্ট ছিল।

 ওই রাতেই আমি অগ্রবর্তী এলাকা পরিদর্শন করলাম। তখন পাক-হানাদার ও আমাদের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হচ্ছিল। আমাদের বাঁ দিকে মিঃ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন ৮নং সেক্টরের সৈন্যদের নিয়োগ করা হয়েছিল। মিঃমাহবুব একজন পি-এস-পি অফিসার। কর্মদক্ষতার জন্য তাকে মেজর পদে উন্নীত করা হয়। তিনি সাহসী ও বুদ্ধিমান। আঘাততের পর আঘাত হেনে শত্রুপক্ষকে সর্বদা ব্যস্ত রাখতেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মিত্রবাহিনীর তরফ থেকে আমরা কোন সাহায্যকারী সৈন্য পাইনি।

 ৭২নং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সৈন্যরা আমাদের অধিকৃত জায়গাগুলো, যেমন বসন্তপুর ও কালিগঞ্জের উপরে তাদারকী করতো। আর তাদের সাহায্য করতো পিছনে আবস্থানরত আমাদের মুক্তিবাহিনী। সুবেদার মেজর এ. জলিল ও লস্করের অধীনে মুক্তিবাহিনী এখানে কাজ করেছে। আমাদের সাথে মর্টার সজ্জিত মুক্তিবাহিনীর একটি দল ছিল। তারা শুধু হানাদারদের গোলাবর্ষণের জবাবে পাল্টা গুলি ছুড়তো। সুবেদার গফুর নামে একজন আভিজ্ঞ মর্টার শিক্ষক পাক-হানাদারদের গুলির জবাবে দক্ষতার সাথে পাল্টা গোলাবর্ষণ করে প্রত্যেকবারই শত্রুদের প্রভুত ক্ষতি সাধন করতো। ভয়ানকভাবে কোণঠাসা হয়ে হানাদারদের মেশিনগানগুলো সব সময় গর্জন করতে লাগলো। যেহেতু আমাদের অবস্থানের চতুর্দিক হানাদারদের দৃষ্টির আওতায় সেজন্য রাত্রে বা দিনে পাহারায় বেরুনোর খুবই কষ্টকর ছিল। কিছুক্ষণর জন্য যুদ্ধ দানবটা দম নিয়ে পুর্নবার আক্রমণ করার জন্য। প্রস্তুতি নিতো।

 ২৩শে নভেম্বর পারুলিয়া থেকে চার মাইল দূরে আর একটা ব্রীজের পেছনে হানাদাররা সরে গেল। সরে যাবার আগে ওরাই এবার নৃশংসতার স্বাক্ষর রেখে গেল। এদিকে আমাদের সৈন্যরা সামনের দিকে আগ্রসর হতে