পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
19

কামানের গোলা, বিশেষ করে এয়ারবাস্তু শেল বিস্ফোরণের ফলে আমাদের কোম্পানীর পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। পাকিস্তানী মেশিনগানগুলোর সঠিক অবস্থান জানার জন্য আমি মাহফুজের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করি। অবস্থান জানতে পারলে ভারতীয় কামান থেকে মেশিনগানের ওপর গোলাবর্ষণ করা যেতো। আমাদের অবস্থান থেকে আমি কিংবা ভারতীয় গোলন্দাজ পর্যবেক্ষক কেউই মেশিনগানগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম না। যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ায় আমাদের সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

 এই পরিস্থিতিতে কোম্পানীকে আরো এগিয়ে যেতে বলা আত্মহত্যারই সামিল ছিলো।

 বল্লভপুর এলাকাতেও আমাদের কোম্পানী কমাণ্ডারকে শুরুতেই থমকে পড়তে হয়। তার দুটি প্লাটুন লক্ষ্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, কিন্তু প্লাটুন কমাণ্ডারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তার হাতে কোন অয়্যারলেস সেট ছিলো না। প্লাটুন দুটির সন্ধান লাভের জন্য সে তখন বার্তাবাহক পাঠায়। তাদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো বটে, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দিনের আলো ফুটে উঠতেই পাকিস্তানীরা আমাদের দেখে ফেলে এবং তাদের কামানগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে।

 এই দুটি আক্রমণেই একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে আমরা সফল হতে পারিনি। কোম্পানী কমাণ্ডারদের যোগাযোগ রক্ষার জন্য আমার কাছে অয়্যারলেস সেট ছিলো অপ্রতুল আর প্লাটুন কমাণ্ডারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য কোম্পানী কমাণ্ডারদের কোন অয়্যারলেস সেট ছিল না। নিজের প্লাটুনগুলোর সাথে সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকলে কোন কোম্পানী কমাণ্ডারের পক্ষে রাত্রে এ ধরনের আক্রমণ চালানো বেশ অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে।

 সাময়িকভাবে আমরা ব্যর্থ হলেও এ দুটো প্রচেষ্টায় আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের সেনারা যুদ্ধের জন্য উল্লেখযোগ্য দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে। যথাযথভাবে পরিকল্পনা নেয়া হলে এবং যোগাযোগের সাজসরঞ্জাম ও ভারী অস্ত্রের সাহায্যে পাওয়া গেল, আমাদের বিশ্বাস, নিশ্চয়ই আমরা জয়ী হতে পারবো।

 যুদ্ধের তখন ছয় মাস চলছে। এ সময়ে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এগুলো পরোক্ষভাবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর নতুন প্রভাব বিস্তার করে। ঘটনাগুলোর একটি হচ্ছে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর। চুক্তি অনুযায়ী দু’দেশ কোন সংকট এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসবে বলে অঙ্গিকার করে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমাদের সাহায্য করার ব্যাপারে ভারত আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করে। ভারতের সরকার এবং জনগণ বুঝতে পারে, বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সে ব্যাপারে এখন আর তারা একা নয়। অচিরেই এই প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রভাব ভারতে এবং বাংলাদেশে, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভারত এতদিন পর্যন্ত খুব সন্তর্পণে এবং সাবধানে এগিয়ে চলছিলো। চুক্তির পর আমাদেরকে সর্বাত্মক সাহায্যের ব্যাপারে তার সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেটে যায়।

 এদিকে দুই পক্ষেই যুদ্ধ পরিকল্পনা আরো ব্যাপকতর হয়ে ওঠে। গেরিলাদের মধ্যে যেন নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়। প্রতিদিনই সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ চলতে থাকে। প্রকাশ্য দিনের বেলাতেও হামলা ও অ্যামবুশ শুরু হয়ে যায়। ভারতীয় ও পাকিস্থানীদের উভয় পক্ষের কামানের গর্জনে সীমান্ত এলাকা হয়ে ওঠে চরম উত্তেজনাময়।

 এদিকে ২৮শে সেপ্টেম্বর নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুরে বাংলাদেশী পাইলটরা ট্রেনিং শুরু করে। গোড়াপত্তন হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর। প্রায় একই সময় পাকিস্তান নৌ-বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা ৪৫ জন নৌ-সেনা নিয়ে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীরও গোড়াপত্তন হয়। সেপ্টেম্বররে দুটি নৌ-যানও আমরা সংগ্রহ করি। এম-ভি পলাশ এবং এম-পি পদ্মা নামের জাহাজ দুটি ছিলো কলকাতা পোর্ট কমিশনারের। প্রায় ৩৮ লাখ টাকা খরচ করে এগুলোকে যুদ্ধের উপযোগী করে তোলা হয়। প্রতিটি নৌযানে দুটি করে ৪০ মিলিমিটার কামান (এল-৬০) বসানো হয়।