পরিদর্শনে আমি খুশী হতে পারিনি। কেননা, সামনে এখনও অনেক দুস্তর পথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে। ২রা ডিসেম্বর পর্যন্ত লেঃ আহসানইল্লাহর কাছ থেকে কোন ফলপ্রসূ খবর পাইনি। রাস্তায় ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পুঁতে শত্রুদের একটিমাত্র জীপ সে উড়িয়ে দিয়েছিল। রাস্তার ধার দিয়ে একটা সুদৃঢ় বাংকার তৈরী করে শত্রুপক্ষ অবস্থান নেয়ায় আহসানউল্লাহ ওদের কাছ ঘেঁষতে পারেনি। শত্রুদের অবস্থান থেকে দু'দিকে প্রায় দু'শো গজ পর্যন্ত উন্মুক্ত ধানক্ষেতও জলাশয়। সবকিছুই ভালভাবে দুষ্টিগোচর হতো না। ডানদিকে মিঃ শাজাহনের বেলায় সঠিক একই অসুবিধা। তাছাড়াও, রাজাকারদের কাছ থেকে তাকে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
অবস্থার কোন উন্নতি হলো না। যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল। শত্রুদের পরিকল্পনা ছিল রাজাকার দ্বারা প্রতিরোধ তৈরী করে রাতের অন্ধকারে আস্তে আস্তে সরে পড়া। সাতক্ষীরা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রায় শতকরা পঁচাশি জন লোক সামরিক চক্রের দালাল হিসাবে হানাদারদের সক্রিয় মদত যুগিয়েছে। তার ফলে সবকিছুই মন্থর গতিতে চলতে থাকে। কিন্তু ইতিহাসের ক্রমবিকাশ ও চিরন্তন গতিকে কে রুখতে পারে? পুর্ব রণাঙ্গনেই শুধু পাকিস্তানী জেনরেলরা বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হলো না, পশ্চিম রণাঙ্গনেও রীতিমত হিমশিম খেয়ে উঠলো। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল যে রকম রীসক্রীগ' কায়দায় আরবদের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক একই কয়দায় পাক- সামরিক জান্তা তাদের বিমান বাহিনীর মিরেজ ও মিগ নিয়ে ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখ রাত্রে ভারতের উপর হহামলা চালায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দ্রিরা গান্ধীও খুব সতর্ক ছিলেন। তিনি ওই রাত্রেই জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে পাক হামলার সমীচীন জবাব দিলেন। সুরায় বিভোর জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান মনে করেছিল রাজনীতি সচেতন বাঙালীকে চিরদিনের জন্য দাবিয়ে রাখতে পারবে এবং এই হীন উদ্দেশ্যেই সে ভারত আক্রমণ করে সমস্যাটার উপর আন্তর্জাতিক রং চাপিয়ে ভারতের সাথে একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সে চরমভাবে ব্যর্থ হলো।
৬ই ডিসেম্বর। বেলা ১১টার সময় অল ইণ্ডিয়া রেডিও মারফত ঘোষণা করা হলো যে, ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। দীর্ঘ ন'মাস যাবৎ সাড়ে সাত কোটি বাঙালী অধীর আগ্রহে দিনটির জন্য প্রতীক্ষায় ছিল। সংবাদটা শুনে মন থেকে চিন্তা ও উত্তেজনা দূরীভূত হলো। হঠাৎ স্বীকৃতির এই ঘোষণা শুনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর এই বিধস্ত অন্তর গর্বে ফুলে উঠলো। স্বীকৃতি শুধু ফাইলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রইল না বা বাতাসে মিলিয়ে গেল না। মিত্রবাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাঁদে কাঁদ মিলিয়ে প্রথম তিনদিনেই যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট অধিকার করে নিলো। সুদৃঢ় অবস্থান ছেড়ে দিয়ে পাক হানাদাররা ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে শুরু করলো। প্রত্যেকেই আশা করেছিল যে, পাক বাহিনী যশোরে আমাদের প্রচণ্ড বাধা দেবে। কেননা, যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট দুর্ভেদ্য বলে মনে করা হতো। কিন্তু হানাদাররা তেমন কোন বাধা দিতে না পারায় মিত্রবাহিনী ও আমরা নিরাশ হয়ে পড়লাম। অথচ মিত্রবাহিনীর কমাণ্ডাররা প্রথমে, মনে করেছিল যে, পাকিস্তানীদের উৎখাত করতে কমপক্ষে ১৫দিন সময় লাগবে।
অপর দিকে আমদের মুক্তিবাহিনী ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে সাতক্ষীরা অধিকার করে সাতক্ষীরা দৌলতপুর রোড ধরে অগ্রসর হতে লাগলো। সাতক্ষীরা অধিকার করে যে পরিমান অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, জ্বালানী তেল, রেশন ও অন্যান্য মুল্যবান জিনিসপত্র আমাদের হাতে এসেছিল, তা দিয়ে পুরো এক বছর যুদ্ধ করা যেতো। কিন্তু এই সময় অধিকৃত জিনিসপত্রের প্রতি আমাদের কোন মোহ ছিল না। আমাদের একমাত্র মোহ, একমাত্র উত্তেজনা শুধু সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। ফেছনে মুক্তিবাহিনীর উপর ওইসব পরিত্যক্ত জিনিসের হেফাজতের ভার দিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা তার বাহিনীর লোকজন নিয়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে অগ্রসর হতে লাগলো।
হানাদাররা পালাবার সময় প্রধান সেতুগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিলো। এর ফলে আমরা খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হলাম। দু'একটা জীপ ছাড়া আমাদের কাছে কোন যানবাহন ছিল না। এই জীপগুলো নানা উপায়ে পার