পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
418

হামলা পরিচালিত হচ্ছিল। বায়ুস্তর ভেদ করে বিমানগুলো উড়ে আসতেই মিঃ দত্ত বেতার যন্ত্র মারফত পাইলটদের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং সঠিক লক্ষ্যস্থলের বর্ণনা দিয়ে আঘাত হানার নির্দেশ দিলেন। পাইলটদের ঠিকমত নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তু চিনে বারবার বিমান নিয়ে 'ড্রাইভ' দিতে লাগলো। হানাদারদের কোন বিমান বা বিমানধ্বংসী কামান না থাকায় তারা এই বিমান আক্রমণের কোন প্রত্যুত্তর দিতে পারল না। অসহায়ের মত শুধু মার খেতে লাগলো।

 ১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ মেজর জেনারেল দলবীর সিং-সাথে তাঁর হেডকোয়ার্টারে সাক্ষাৎ করলাম। দেখলাম গাড়ীর ভেতর তিনি একটি ম্যাপ দেখছেন এবং খুবই ব্যস্ত। তাঁকে ভয়ানক বিরক্ত ও রাগান্বিত মনে হলো। কেননা, প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করার পরও তিনি এগুতে পারছিলেন না। তার অগ্রগতি থেমে গিয়েছেল।

 ভারতের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশ” অল ইণ্ডিয়া রেডিও মারফত ঘোষণা করলেন যে, আত্মসমর্পনকারী সৈন্যদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হবে। তৎসত্ত্বেও শত্রুপক্ষের আত্মসমর্পণ করার কোন লক্ষণ দেখা গেল না।

 জেনারেল দলবীর সিং তাঁর একটি বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার কাছে আমার কাছে কয়েকজন দক্ষ লোক চাইলেন। উদ্দেশ্য, শত্রুদের বাঁদিক থেকে আক্রমণ করে বিভ্রান্ত করে ফেলা। তাড়াতাড়ি হেডকোয়ার্টারে ফিরে গিয়ে খুলনার পথ-ঘাট যাদের ভাল জানা আছে এ-রকম পাঁচজন আমি নির্বাচিত করলাম।

 ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ গতরাতে মুষলধারে বৃষ্টি থাকার মিত্র বাহিনী সামনে এগুতে পারলো না। আজকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে। এদিকে লেঃ দত্তের তত্ত্বাবধানে দৌলতপুর ও খুলনার কয়েকটা নির্দিষ্ট জায়গায় বিমান হামলা চালানো হলো। বারবার বিমান হামলায় খুলনা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেখে মনে ব্যথা অনুভব করলাম এবং পাক হানাদাররা এখনও আত্মসমর্পণ না করায় মনে মনে ওদের অভিশাপ দিতে লাগলাম। আজকে একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা বুলেটের আঘাতে প্রাণ হারায়। ক্যাম্পর আর একজন মুক্তিযোদ্ধা রাইফেলের ম্যাগাজিন খালি ভেবে ট্রিগারে টিপ দেয়, যার ফলে এই মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারনা হয়। মুক্তিযোদ্ধাটি একজন এস-এস-সি পরীক্ষার্থী। মুকড়া স্কুল প্রাঙ্গণে ওকে সমাহিত করা হয়েছিল। স্থানীয় স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলাম, তারা যেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তার নামে স্কুলটির নামকরণ করে।

 ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ দিনটা মেঘাচ্ছন্ন। কিছুটা ক্লান্তিও বিষণ্ন বোধ করতে লাগলাম। গতরাত্রের পরিকল্পনামাফিক মিত্র বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক' খুলানার দিকে অগ্রসর হলো। কিন্তু ফলাফলের কোন খবর পেলাম না।

 সকাল দশটা। শাহপুর স্কুলে কতকগুলো ছেলের দাঁড়িয়ে সাথে ছিলাম। ক্যাপ্টেন হুদার জীপ এসে থামতেই সে একটা দুষ্ট ছেলের মত লাফিয়ে পড়ে গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এ-রকম করতে আগে তাকে কখনও দেখিনি। তার এই ব্যবহার দেখে খবই বিস্মিত হলাম। সে এক রকম কাঁপতে কাঁপতে বললো, “অত্যন্ত সুখবর স্যার, পাক সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছে এবং ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল জ্যাকপ ইতিমধ্যে ঢাকায় অবতরণ করেছেন।”

 সংবাদটা অবিশ্বাস্য মনে হলো। কেননা, কল্পনাও করতে পারিনি যে, ওই হিংস্র পশুগুলো এত তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণ করবে। তবুও এ সংবাদটা শুনে আমার সারা দেহে তপ্ত রক্তস্রোত বইতে লাগলো। চিৎকার করে ছেলেদের উদ্দেশ্য বললাম, 'আমরা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি।'