পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
419

 আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত। ছেলেরা সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করতে লাগলো। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ডিগবাজি খেয়ে ঘাসের উপর গড়াগড়ি করতে লাগলো। সবাই এক সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো, 'তোমার নেতা, আমার নেতা-শেখ মুজিব।'

 আমি এবং হুদা মিত্রবাহিনীর ৯নং ডিভিশনের সদর দপ্তরে গিয়ে মেজর জেনারেল দলবীর সিংহকে তাঁর বাহিনীর অপর দু'জন অধিনায়কসহ খোশ মেজাজে বসা দেখলাম। আমাদের দেখে তাঁরা সবাই উল্লসিত হলেন এবং আমাদের স্বাগত জানালেন।

 সময় বেলা ১২টা। কামানগুলো নীরব। আমরা একটা ট্রানজিস্টারের কাছে বসে ঢাকার খবরাখবর শুনতে লাগলাম। শুনলাম পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেনারেল নিয়াজী তাঁর অধীনস্থ সমস্ত সৈন্য নিয়ে সকাল সাতটায় মিত্র-বাহিনীর লেঃ জেনারেল অরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন। একদিকে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয়ের আনন্দ, অপরদিকে ওদের অপমানজনক পরাজয়ের তীব্র গ্লানি।

 যাহোক, এদিকে খুলনাকে নিয়ে বড্ড দুর্ভাবনায় পড়লাম। তখন পর্যন্ত এখানকার শত্রুপক্ষের আত্মসমর্পণ করার কোনই লক্ষণ দেখা গেল না। উত্তেজনায় জেনারেল দলবীর সিং টেবিল ধাপড়ে বললেন, ‘যদি ওই শয়তানগুলো এখন আত্মসমর্পণ না করে, তাহলে আমার নিকট যে গোলন্দাজ বাহিনী আছে, তা পাঠিয়ে দিয়ে ওদের মাটির সাথে মিশিয়ে দেব।”

 সময়ের চাকাটা ঠিকমতই চলতে লাগলো। কিন্তু আমাদের সামনে যে শত্রু রয়েছে, তারা যেন স্থবির। সবাই আমরা বসে। প্রতি মুহূর্তে আশা করছি এইবার বুঝি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করবে। সূর্য ডুবে গেল, কিন্তু আত্মসমর্পণের কোন আভাস পাওয়া গেল না। আজ ঢাকার শত্রুপক্ষ আত্মসর্পণ করলো। কিন্তু খুলনায় আত্মসমর্পণ করতে ওরা অস্বীকৃতি জানালো। মনে হলো, খুলনায় শত্রুপক্ষের কমাণ্ডার অত্যন্ত শক্ত লোক। আমি আমার হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলাম।

 রাতটা ভয়ানক অস্বস্তিতে কাটলো। আমরা কেউ ঘুমাতে পারলাম না। মিত্রবাহিনীর কামানগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠলো। মাঝে মাঝে প্রত্যুত্তরে শত্রুপক্ষের কাছ থেকেও জবাব আসছিল। ওদের গোলাবারুদ হয়তো শেষ হয়ে আসছে। আমি আশাবাদী ছিলাম যে, আগামীকালই আমরা বিজয়ীর বেশে খুলনায় প্রবেশ করতে পারবো। বিগত ন'মাসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজ আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো।

 ১৭ই ডিসেম্বর,১৯৭১ সালঃ গত রাতে ক্যাপ্টন হুদার সাথে পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে, মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশ লোককে লেঃ মোহাম্মদ আলির তত্তাবধানে দৌলতপুর রোড দিয়ে খুলনায় পাঠিয়ে দিতে হবে। ওদের ভেতর ষাটজন মুক্তিযোদ্ধাকে গাড়িতে চাপিয়ে প্রস্তুত করে রাখলাম, যেন ওরা নির্দেশ পাওয়া মাত্র আমাদের সাথে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারে। সকাল বেলা সবাই প্রস্তুত। চরম বিজয়ের অভিযানের উত্তেজনায় সবাই কাপছে। ক্যাপ্টেন হুদা, ডাঃ শাজাহান ও মোস্তাফাকে সাথে নিয়ে সকাল সাতটার মিত্রবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে গিয়ে পৌঁছালাম। গাড়ীতে যেসব মুক্তিযোদ্ধা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল তারা আমাদের পিছে পিছে রওনা হলো। রাস্তায় শত শত গাড়ীর ভীড়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন মিত্রবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে গাড়ী ছাড়ার সংকেত সবুজ বাতি জ্বলে উঠবে এবং খুলনার দিকে অগ্রসর হবে। মিলিটারী পুলিশ স্ট্যাণ্ডের নিকট সবার আগে আমাদের গাড়ী দাঁড় করালাম। ৯নং মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে আমাকে স্বীকৃতি দেয়ায় মিত্র বাহিনী আমাকে গাড়ী পার্ক করার অনুমতি দিল। অন্যথায় কোন বেসামরিক লোককে মিলিটারী পোস্টের একশো গজের মধ্যে গাড়ী পার্ক করার অনুমতি দেয়া হতো না। পিছন দিকে চেয়ে দেখলাম অসংখ্য দেশী-বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার গাড়ীর চারদিকে ভিড় করে আছে। আমি হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত হেঁটে গেলাম।কারও উপর কারো নিয়ন্ত্রন ছিল না। সবাই ব্যস্ত-সমস্ত। বিজয়ের লগ্নটা আজ কত না প্রাণবন্ত। প্রতিটি মুহূর্ত