পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
421

 ‘মৃত পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ বলবেন কি? আমি একথা বলতেই ব্রিগেডিয়ার হায়াত অসহায়ের মত আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উপায়ন্তর না দেখে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি তাঁর ভুল সংশোধন করে নিলেন। চা খেয়ে আমরা সবাই সার্কিট হাউসে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। এই যাত্রাটা খুবই আনন্দকর। আমরা খুলনা শহরের কাছাকাছি আসতেই রাস্তার দু'পাশের লোকজন গগনবিদায়ী চিৎকারে আমাদের স্বাগত জানালো। ‘জয়বাংলা' ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত। আজ মনে হলো 'জয় বাংলা' বাস্তব সত্য। প্রত্যেক বাড়ির চূড়ায়, দোকানে বাংলাদেশের পতাকা। প্রতিটি নারী-পুরুষ ও শিশুর হাতেই বাংলাদেশের পতাকা। হাত নেড়ে উল্লসিত জনতার অভিনন্দনের জবাব দিলাম। সবার মুখেই হাসি। শিগগিরই আমরা সার্কিট হাউজে পৌঁছালাম। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে এদিকে আসতে লাগলো। সার্কিট হাউসের উপরে বাংলাদেশের পতাকা শোভা পাচ্ছে। বুকটা গর্বে ফুলে উঠলো। সমুন্নত পতাকার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। হাজার হাজার উৎসুক মানুষ সার্কিট হাউস ঘিড়ে রয়েছে এবং সবাই সামনে আসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

 যে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরা নিরীহ বাঙালীদের উপর এতদিন অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের একনজর দেখার জন্য জনতা বাঁধভাঙা স্রোতের মত ছুটে আসতে চাইলো। জনতার অসম্ভব ভীড় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ করা হয়েছে।কিন্তু জনতার চাপ এত বেশী যে, মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই ওদের সামলাতে পারছে না। সার্কিট হাউজের দরজায় নামতেই এত ভীড়ের মধ্যেও পিষ্ট হতে হতে জনতা আমাদের দেখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো। কেউ আনন্দে হাততালি দেয়, কেউ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, কেউবা পাগলের মত ছুটে এসে চুমু খায়। কি অপূর্ব দৃশ্য! মানবতার কি মহান বহিঃপ্রকাশ। সব হারাবার দুর্বিষহ জ্বালা ভুলে গিয়ে নতুন দিনের নতুন সূর্যকে কত আপন করে কাছে নিতে চায়। মহামানবের তীর্থসলিলে অবগাহন করে অবহেলিত জনতা আজ যেন নতুন প্রাণের সন্ধান পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ওরা আজ মুক্ত, ওরা আজ স্বাধীন। প্রতিটি জিনিস আজ নিজস্ব। ইতিমধ্যেই একটা হেলিকপ্টার জেনারেল দলবীর সিংকে নিয়ে সার্কিট হাউজে অবতরণ করলো। লম্বা, উন্নত চেহারার অধিকারী জেনারেল দলবীর সিং সার্কিট হাউজ পর্যন্ত হেঁটে আসলেন এবং আত্মসমর্পণের পর্বের খুঁটিনাটি বিষয় ঠিক না করা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। সবুজ ঘাসের উপর লাল কার্পেট বিছানো। তার উপর একটি টেবিল ও একটা চেয়ার।

 ঐতিহাসিক মুহূর্তটি সমাগত। সুশিক্ষিত আট হাজার পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের কমাণ্ডারদের আত্মসমর্পণ। যে দাম্ভিক পাকিস্তানী সৈন্যরা হিংস্র কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করতো, তারা আজ নিরীহ মেষশাবকের মত আত্মসমর্পণ করলো। জেনারেল দলবীর সিং চেয়ারে উপবিষ্ট। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তার সাথের আটজন কর্নেল নিয়ে মার্চ করে তাঁর সামনে এসে থামলেন। পাকিস্তানী কমাণ্ডাররা যখন সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে মার্চ করে আসছিল, তখন বাইরে আপেক্ষমাণ হাজার লোক আনন্দে ফেটে পড়লো। কেউ হাততালি দেয়। কেউবা শিস দেয়। কি গ্লানিকর পরাজয়! কত বড় শাস্তিমূলক অনুষ্ঠান। জেনারেল দলবীর সিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, পাকিস্তানী অপরাধীগুলো এটেনশান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুষ্ঠান খুবই সাদাসিধা। জেনারেল দলবীর সিং আত্মসমর্পণের দলিল পাঠ করলেন এবং পা-বাহিনীর পরাজিত কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান মাথা নুইয়ে কম্পিত হাতে দলিলে স্বাক্ষর দিলেন। সোজা হয়ে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান ও তাঁর সাথের অন্যান্য অফিসাররা কোমরের বেল্ট খুলে মিত্রবাহিনীর কাছে অর্পণ করলেন। এই সময় সমস্ত ফটোগ্রাফার ফটো নেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগে গেল। দেখে মনে হলো যেন একটা বিয়ের পর্ব। ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের পক্ষে এই রকম গ্লানিকর আত্মসমর্পণ আমি আর কখনও দেখিনি। অত্যন্ত অপমানজনক পরাজয়।