পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
430

 আমরা জেলায় প্রবেশ করার পরের দিনই পাতারহাটের অনতিদূরে ক্যাপ্টেন ওমরের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর একটি গানবোট ও দুটো লঞ্চ আক্রমণ করি এবং প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হই। এই সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন পাকসৈন হতাহত হয়। ক্রমে ক্রমে আমাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বরিশালের মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট দলগুলো একে একে ক্যাপ্টেন ওমরের একক নেতৃত্বে আমাদের সাথে যোগ দিল। আমাদের শক্তি আরও বেড়ে গেল। একে একে জয়শ্রী, উজিরপুর, বানারিপাড়া প্রভৃতি স্থানে সাফল্যজনক অপারেশর চালানো হয়।

 প্রথম দু'টি স্থানে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম না। গেরিলা কমাণ্ডো জামালের নেতৃত্বে আমি, নুরু, ওদুদ, হাকিম, ইসমাইল, সাখাওয়াত, আলতাফসহ ৮০ জনের একটি দল সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বানারিপাড়ায় অপারেশন চালাই। ৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পরে আমি, সাখাওয়াত, আলতাফ উইথড্রয়াল সংকেত পাওয়ার পর থানার ঘাট থেকে থানার একটি লঞ্চ নিয়ে শিবিরে চলে আসি। এখানে বিপক্ষ দলের কয়েকজন হতাহত হয়। ওখানে কিছুদিন থাকার পর ক্যাপ্টেন ওমরের কতগুলি যুদ্ধ সম্বন্ধীয় তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট নিয়ে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে চলে আসি। এখানে একজন লোকের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তার সাহায্য না পেলে দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল অরণ্য সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচল ও তৎপরতা চালানো হয়ত অসম্ভব না হলেও অতটা সহজসাধ্য হোত না। এই লোকটির নাম রয়জদ্দিন-শিক্ষক আলোক থেকে বঞ্চিত। এই লোকের কাছে আসি উজ্জ্বল দেশপ্রেমের নিদর্শন পেয়েছি। সুন্দরবন এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থান ও সম্ভাব্য আনাগোনা ছিল তার নখদর্পণে। সুন্দরবনের দুর্গম ও অজ্ঞাত পথ দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে মুক্তিবাহিনীর পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতো। সুন্দরবন দিয়ে আসা-যাওয়ার শতাধিক পথ তার জানা ছিল। আমি এবং আমার তিনজন সঙ্গী কবীর, খালেক ও নওশের এই রয়জদ্দিন মাঝির সাহায্যে ভারত এস পৌঁছাই। ভারতে এসে মেজর জলিল সঙ্গে দেখা করি। তিনি তখন থাকতেন টাকি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রগুলি পেয়ে উনি খুশি হলেন। ঐদিনই উনি আমাকে একটা দল নিয়ে পটুয়াখালী জেলার আসার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন।

 আমি ৬০ জনের একটি দল সংগঠন করলাম। সেপ্টেম্বর মাসের একরাতে আরও অন্যান্য দলসহ প্রায় ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা রয়জদ্দিন মাঝির সাহায্যে সুন্দরবন দিয়ে সুন্দরবনের একটি ঘাঁটি বগীর দিকে অগ্রসর হই। বগী পৌঁছাতে প্রায় ৮/১০ দিন লেগে যায়। আমাদের অভ্যর্থনা জানায় সুন্দরবন এলাকার কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন জিয়া। বগী থেকে যার যার নিদের্শিত এলাকায় যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকি। পাকবাহিনীটের পায় আমাদের অবস্থান। গানবোট আক্রমণ চালায় আমাদের ক্যাম্পে। মর্টার সেলিং চালাতে থাকে অনবরত। কিন্তু আমাদের কাছে লং-রেইঞ্জ ফায়ারিং অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় এল-এম-জি-আর,৩০৩ রাইফেল নিয়ে নদীর কূলে পজিশন নিয়ে থাকি। ওরা প্রায় ২ মাইল দূর থেকে শেলিং করে। কাছে আসতে সাহস না পেয়ে ছ'ঘণ্টা অনবরত শেলিং করার পর গানবোট নিয়ে চলে যায়। রাতে আমরা আমাদের অবস্থান সুন্দরবনের আরো একটু ভেতরের দিকে সরিয়ে নিই। পরের দিন সকালে আবার গানবোট আক্রমণ চালায় এবং সকাল ১১ টার দিকে ওরা চলে যায়। সাত মাইল প্রশস্ত বগী নদীতে সন্ধ্যা ৭ টার দিকে পাড়ি শুরু করে রাত ১০ টার ওপারে চলে আসি। যার যার দল নিয়ে এবং পথপ্রদর্শক নিয়ে আমরা আমাদের নির্দেশিত এলাকার দিকে পায়ে হেঁটে রওনা দিই।

 সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে প্রয়োজনীয় কতকগুলো কাগজপত্র দিয়ে মেজর জলিল আমাকে পটুয়াখালী জেলার সাব-সেক্টর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদীর সাথে দেখা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম তখন ধামুরাহাটের কাছাকাছি বুকাবুনিয়ায় থাকতেন। তার ছদ্মনাম ছিল ক্যাপ্টেন কুমার। আমার তারিখটা ঠিক মনে নেই, তবে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমি আমার দল নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করি। আমাদের পেয়ে তিনি খুশী হলেন। সাথে সাথে তিনি সকল এলাকা থেকে ছোট ছোট দলগুলোকে তার হেডকোয়ার্টারে ডেকে পাঠালেন। সমস্ত জেলার ১০টা থানাকে তিনি মোট পাঁচটা ভাগে ভাগ করলেন। প্রতিটি জোনের জন্য একজন করে জোনাল কমাণ্ডার ঠিক করে দিলেন।