পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
21

 ইয়াহিয়ার এই বক্তৃতার বিশেষ কয়েকটি দিক লক্ষণীয়। সবকিছুর জন্য তিনি বরাবর ভারতকেই দোষারোপ করেছেন এবং সচেতনভাবে মুক্তিবাহিনীর কথা এড়িয়ে গেছেন।

 এতে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, তিনি যুদ্ধ করার একটা অজুহাত খুঁজছেন। এক বন্ধ উন্মাদ, যে মুক্তিবাহিনীর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, ক্রোধোন্মত্ত- তাঁর কথায় সেটাই প্রমাণিত হলো। ততদিনে আমরা তাকে আরো নির্মম আঘাত হানার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলিছি।

 জুলাই মাস থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার তেল সংরক্ষণাগারে একটা আক্রমণ চালানোর জন্য আমরা পরিকল্পনা করছিলাম। এ কাজের জন্য বিশেষভাবে বাছাই করা কয়েকটি ছেলেকে আলাদাভাবে ট্রেনিং দেয়া হয়। কিন্তু উপরোক্ত হাতিয়ার না পাওয়ায় অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। পাকিস্তানের বিমানের জন্য উচ্চ দাহ্যশক্তিসম্পন্ন জ্বালানী ভর্তি ট্যাংকগুলো ছিলো সংরক্ষণাগারটির প্রধান আকর্ষণ। ১৬ই অক্টোবর ট্রেনিংপ্রাপ্ত গণ-পরিষদ সদস্য জনাব মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে বিশেষ দলকে উক্ত তেল সংরক্ষণাগারে আক্রমণ চালানোর জন্য পাঠানো হয়। আক্রমণের আগের রাতে শত্রুরা কিভাবে যেন শহরে গেরিলা দলের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। চট্টগ্রামে তারা যেখানে উঠেছিলো পাকিস্তানিদেরর সে এলাকা ঘিরে ফেলে। সৌভাগ্যক্রমে একটি ড্রেনের ভেতর দিয়ে আমাদের পুরো দলটি আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়। কিন্তু তাদের অস্ত্রশস্ত্র খোয়া যায়। ফলে আক্রমণের পরিকল্পনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।

 ওদিকে ইয়াহিয়া খান ভারত আক্রমণের একটি যথাযথ অজুহাত খুঁজছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটি মারাত্মক আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করে বাংলাদেশের সমস্যা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো যাবে। তাঁর সমর-অধিনায়করাও সে ধরনের একটি যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সৈয়দপুরে এক জনসমাবেশ পাকিস্তানীদের হস্টার্ন কমাণ্ডের কমাণ্ডার লেঃ জেনারেল নিয়াজী ঘোষনা করলেন, উভয় ফ্রণ্টেই পরবর্তী যুদ্ধ ভারতের মাটিতেই হবে। নিয়াজীর মুখ থেকে কথাটা বোধ হয় বেফাঁস বেরিয়ে পড়েছিলো- কারণ ইয়াহিয়া খান তখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে যুদ্ধের কথা বলেননি। কিন্তু না বললে কি হবে, ২০ এবং ২২শে অক্টোবর পাকিস্তানীদেররা সীমান্ত থেকে ভারতের পাঁচ মাইল অভ্যন্তরে কমলপুর গ্রামের ওপর গোলাবর্ষণ করলো। যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানী উস্কানিমূলক তৎপরতায় বহুসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং আহত হলো। একদিন পর ২৩শে অক্টোবর পাক বাহিনী পশ্চিম ফ্রণ্টের সম্ভাব্য রণাঙ্গনগুলোতে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে।

অঘোষিত যুদ্ধ শুরু

 নভেম্বর নাগাদ ভারতের তিনটি কোরের অধীনে সাতটি পদাতিক ডিভিশন যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্ত্ততি গ্রহন করে। কুম্ভীগ্রামের ঘাঁটি পুনরায় চালু করা হয় এবং ভারতীয় নৌ-বাহিনীর ইস্টার্ন ফ্লীটকে সক্রিয় করা হয়। যেকোন আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য তাদের ব্যাপক পরিকল্পনা তখন চূড়ান্ত।

 ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব ফ্রণ্টে পাকিস্তানের সকল দুস্কর্মের উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলো। এ সময়ই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বেলুনিয়া পুনর্দখল করার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। একই সঙ্গে অন্যান্য সেক্টরেও অনুরূপ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বেলুনিয়া ৫ই নভেম্বর আক্রমণের (ডি-ডে) দিন নির্ধারিত হয়।

 কিন্তু ৪ঠা নভেম্বর এক মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা সকলেই বিচলিত হয়ে পড়ি। আমার অন্যতম সাব- সেক্টর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা সেদিন রাত সাড়ে ৮টায় মারা যান। বেলুনিয়া অভিযানে তিনটি কোম্পানীকে তাঁর নেতৃত্বে রাখার পরিকল্পনা ছিলো। অকুতোভয় যোদ্ধা হিসাবে সৈন্যরা তাঁকে ভালবাসতো, প্রশংসা করতো। আমি নিজেও দেখেছি কি নির্ভীকভাবে রণাঙ্গনের অগ্রবর্তী এলাকায় তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এরূপ