পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
440

বগিঃ বরিশাল-খুলনা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বলেশ্বর নদী। এই নদী ৬ মাইলের মত প্রশস্ত। বগি শরণখোলা থানার দক্ষিণ অঞ্চলে জনবহুল এলাকা সংলগ সুন্দরবন ফরেস্ট অফিস। বলেশ্বর নদীর পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত এই বগিতে আমাদের যোগাযোগের প্রধান ঘাঁটি করা। বগিতে আমাদের মজবুত সৈন্য বাহিনী ছিল। গানবোটের সাথে প্রতিদিন যুদ্ধ চলত। শত চেষ্টা করেও গানবোট হতে পাক সেনারা তীরে উঠতে পারেনি।

 বগির যুদ্ধঃ আগস্ট মাসের দিকে বরিশাল-পটুয়াখালী-ফরিদপুর থেকে প্রায় এক লক্ষ শরণার্থী খানসেনা ও রাজাকারদের অত্যাচারে বগিতে আশ্রয় নিল। এমনি এক সময়ে হঠাৎ ৫ খানা গানবোট বগিতে আমাদের ক্যাম্পের উপর গুলি চালায়। তারা বলেশ্বর নদী হতে সব স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করে। মর্টার ও আর-আরের গুলিতে মাটি কেপেঁ উঠেছিল। তখন আমাদের মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা ৫ খানা গানবোটের মোকাবেলা করে। যখন গানবোট তীরের দিকে আসতে থাকে তখন মুক্তিযোদ্ধারা চুপচাপ। গানবোট যখন নদীর কিনারে আসে এবং খানসেনারা তীরে উঠবার জন্য গানবোটের উপরে ওঠে, ঠিক এমনি সময়ে মুক্তিবাহিনী এল-এম-জির ব্রাশ ফায়ার করে- অনেক খানসেনারা মারা যায়। দুইদিন যাবৎ যুদ্ধ চলে, কিন্তু তারা তীরে উঠতে পারেনি।

 এদিকে গানবোটের ভয়ে শরণার্থীরা গ্রাম ছেড়ে বগি নদী পার হয়ে সুন্দরবনের মধ্যে প্রবেশ করে। ৪ জন শরণার্থী মারা যায় মর্টারের গুলিতে। অনেক ছোট ছেলেমেয়ে হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন জিয়া ও আমি ২৫ জন লোক নিয়ে একটি কমিটি গঠন করি এবং তাদের ভারতে পাঠাবার ব্যবস্থা করি।

 ভারত থেকে ৯নং সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর জলিল ১৫/২০ দিন অন্তর শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে বগিতে পাঠাতেন এবং অস্ত্র পাঠাতেন। আমরা তাদের বরিশাল জেলায় কমাণ্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন শাজাহান ও পটুয়াখালী জেলায় কমাণ্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন মেহেদীর নিকট কাঠকাটা নৌকায় অতি সাবধানে পাঠাতাম। যুদ্ধের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এরূপ চলত।

 শরণখোলা রেঞ্জ অফিসঃ এটাও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ঘাঁটি ছিল। এটাকে বলা হতো পশ্চাৎভূমি। হেডকোয়ার্টার হতে এসে প্রথম এখানে স্থান নেয়া হতো, তারপর নির্দেশ অনুসারে যাত্রা করা হতো। এখানে স্থানীয় জনসাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য পাঠাতো। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস হতে উত্তর দিকে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ধরে আনতো এবং বিচার-আচার করা হতো।

 পাকিস্তান হাটের যুদ্ধঃ একদিন শোনা গেল ‘পাকিস্তান' নামক একটি হাট রয়েছে শরণখোলা থানায়। সেখানে রাজাকাররা জনসাধারণের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তখন শহীদ আসাদ মাত্র ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করে। দেড়শত রাজাকার রয়েছে ওখানে। দুইঘণ্টা যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের হটিয়ে দিয়ে ৩ জনকে বন্দী করে নিয়ে আসে এবং দুটি রাইফেল পায়।

 তাফালবাড়িতে যুদ্ধঃ তাফালবাড়িতে আমাদের একটি ক্যাম্প ছিল। রাজাকার এবং পাঞ্জাবী পুলিশরা হঠাৎ ক্যাম্পে আক্রমণ করে এবং ক্যাম্পের চারদিক ঘিরে ফেলে। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। ইতিমধ্যে বগি ক্যাম্প হতে ২০ জন নিয়ে যখন পিছন হতে আক্রমণ চালানো হয়, তখনি পাকসেনারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ৪জন রাজাকার মারা যায়। ১০ টি রাইফেল উদ্ধার করাহয়।

 বরিশালের মাপলাজাড়ঃ বরিশাল জেলায় মাঠবাড়িয়া থানায় মাপলাজাড় নামক স্থানে ব্যাপক অত্যাচার করে এবং সেখানকার জনসাধারণ খুব অসুবিধা ভোগ করে। বগি ক্যাম্প হতে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা রাত্রে গোপনে এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বেলা ১০ টার সময় পাঞ্জাবী পুলিশ এবং রাজাকার ৫০ জন গ্রামে এসে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে থাকে। মাত্র ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করে। সেখানে ১০ জন শত্রু