পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
22

একজন অফিসারকে দেখলাম তাঁর ক্যাম্পের মধ্যে পড়ে আছেন, প্রাণহীন নিস্পন্দ। জায়গায়টি রক্তে ভেসে গেছে, মাথার খুলী ছিন্নভিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে চারদিকে ছড়ানো। কয়েক মিনিট আগেও তিনি তাঁর সৈন্যদের সাথে কথা বলেছেন, পরের দিনের অভিযান সম্পর্কে কয়েকটি চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছেন। যতদূর জানা যায়, বাড়ি থেকে তাঁর খুব খারাপ খবর এসেছিল। বিগত কয়েক মাস ধরে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে যুদ্ধ করছিলাম। অনিশ্চয়তা ও হতাশায় মনোবল ঠিক রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো কিছু লোকের পক্ষে। আমার সেক্টরে বাড়িঘর নিয়ে কিংবা পারিবারিক কোন বিষয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলাম। খুবই নিষ্ঠুর আদেশ সন্দেহ নেই, কিন্তু সৈনিকগণের ওপর ক্ষতিকর আবেগ সৃষ্টি করতে পারে এমন ধরনের কথাবার্তা থেকে বিরত রাখার জন্যেই এটা করতে হয়েছিলো। আমাদের দুর্ভাগ্য, ৪ঠা নভেম্বর রাত সোয়া ৮টার দিকে ক্যাপ্টেন শামসুল হুদাকে তাঁর বিছানায় বসে কি যেন চিন্তা করতে দেখা যায়। সীমাহীন এক অবসাদ তাঁকে পেয়ে বসেছিলো। এক সময় আপনার অজান্তেই তিনি স্টেনগান হাতে তুলে নিয়ে নলটি নিজের চিবুকে ঠেকান। তারপর যন্ত্রচালিতের মতো ট্রিগার চালান।

 বেলুনিয়া অভিযান নিয়ে আমি তখন ভারতীয় ব্রিগেড কমাণ্ডারের সাথে আলোচনা করছিলাম। খবর পেয়ে প্রথম বিশ্বাসই করতে পারিনি। কিন্তু কঠিন বাস্তবতাকে এক সময় স্বীকার করে নিতেই হলো। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামীকালই অভিযান শুরু হবে। পুরো একটা জাতির ঘোর দুর্দিনে ব্যক্তিজীবনের ট্রাজেডীগুলো আমরা শুধু মনে মনেই রাখতে পেরেছি, আর কিছু করতে পারিনি সেদিন।

 নিয়মিত পদাতিক বাহিনী এবং মিলিশিয়া নিয়ে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানের শক্তি ছিলো দুই ব্যাটালিয়নের মতো। এক ব্যাটালিয়ন ছিলো উত্তরের অংশ এবং বাকী অংশ ছিলো দক্ষিণ ভাগে। শক্তিশালী বাংকার তৈরী করে এবং বেশ বিস্তৃত এলাকা জুড়ে মাইন পেতে তারা অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। এ সমস্ত অবস্থান সম্পর্কে সন্ধান না নিয়ে আক্রমণ চালালে অহেতুক লোকক্ষয় হতে পারে। কোনভাবে উত্তরের অংশের শত্রুদলকে বাকী অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচ্ছিন্ন অংশে সাহায্য সহযোগিতা প্রেরণ বন্ধ করতে পারলে পাকিস্তনীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। আত্মসমর্পণ না করলেও কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের নির্মূল করা সম্ভব হবে। আমরা তাই সিদ্ধান্ত নেই, উত্তরের এবং দক্ষিণের এই দুই অংশের মাঝামাঝি কোন স্থানে অতি সন্তর্পণে রাত্রির অন্ধকারে নিঃশব্দে অবস্থান গ্রহণ করবো। ট্রেঞ্চ এবং বাংকার গড়ে তুলব রাতারাতি। এবং পরদিন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়লেই পাকিস্তনীরা দেখতে পারবে তাদের উত্তরের অংশ দক্ষিণের বাহনী থেকে রাত্রির অন্ধকারে হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন। মাঝখানে বসে আছে তাদের যমদূত মুক্তিসেনারা।

 নভেম্বর ৪ তারিখ। অন্ধকার এবং শীতের রাত। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। ক্যাম্প ছেড়ে বেলনিয়া অভিযানে এগিয়ে চলে মুক্তিসেনাদের দল। সৈন্যদের দীর্ঘসারি যাত্রা শুরু করতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টির সাথে বাতাসের বেগও বেড়ে যায়। হাড় কাঁপানো শীতে আমাদের ঠোঁট কাঁপছিল। আমরা পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কষ্ট হলেও বস্তুত আমাদের সুবিধেও ছিলো যথেষ্ট। আবহাওয়া খারাপ দেখে সে রাতে শত্রুদের টহলদাররা আর বাইরে বেরোয়নি। তারা ধারণাও করতে পারেনি যে এই রাতটিকেই আমরা বেছে নেবো। দমকা বাতাসের গর্জনে আমাদের চলাফেরা এবং ট্রেঞ্চ খোঁড়ার আওয়াজ তলিয়ে যাচ্ছিলো। ভোর হতে না হতেই আমাদের সবগুলো কোম্পানী যার যার জায়গায় পৌঁছে প্রতিরক্ষামূলক ট্রেঞ্চে অবস্থান গ্রহণ করে। আমরা তখন শীতে প্রায় জমে যাচ্ছিলাম। কিন্তু একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গিয়ে পরিষ্কার সূর্যালোক চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

 দেরি না করে আমরা নিকটবর্তী শরণার্থী শিবির এবং গ্রাম থেকে লোক নিয়ে সাজসরঞ্জাম বহনের ব্যবস্থা করি। যানবাহন চলাচলের জন্য পাহাড় এবং ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে চার মাইল দীর্ঘ রাস্তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হয়। হাজার হাজার লোক স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিনরাত কাজ করে চলে। তিনদিনের মাথায় রাস্তাটি যানবাহন চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠে। আমাদের সাহায্য করার জন্য বেসামরিক লোকদের মধ্যে অভূতপূর্ব উৎসাহ লক্ষ্য করি। ফলে আমাদের মনোবল বেড়ে যায় বহুগুণ।