পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
450

ছিল-একটি বেলুচ রেজিমেণ্টের, অপরটি মিলিশিয়া বাহিনীর। ব্যাপকভাবে উভয় পক্ষের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিবাহিনীর ৪ জন নিহত এবং বেশকিছু আহত হয়। পাকিস্তানীদের ১০০ জন নিহত হয়।

 অক্টোবর মাসের প্রাথমদিকে আরও পাঁচজন অফিসার পেলাম। তারা হলেন ৯১০ লেঃ কামাল (২) লেঃ আলিম (৩) লেঃ তাহের (৪) লেঃ মিজান এবং (৫) লেঃ হাশেম। লেঃ কামাল এবং লেঃ তাহেরকে ডালু সাবসেক্টরে, লেঃ হাশেমকে পুরাকাশিয়াতে এবং লেঃ মিজানকে মহেন্দ্রগঞ্জ সাবসেক্টরে কাজ করতে বলা হলো।

 আমার হেডকোয়র্টারে কেবলমাত্র গরীব কৃষকদের নিয়ে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি। প্রাথমিক পর্যায়ে ২৫০ জন কৃষক নিয়ে কাজ শুরু করি। এইসব কৃষক পরবর্তীতে যুদ্ধের ময়দানে ব্যাপকভাবে যে কোন সামরিক ট্রেইণ্ড সৈনিকের চাইতে দক্ষতা প্রদর্শন করেছিল। তার কারণ বোধ হয় কৃষকের অধিকাংশই ছিল পাকিস্তানীদের দ্বারা অত্যাচারিত। আর তাই তাদের বুকে জ্বলছিল প্রতিহিংসার আগুন।

 অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি ডালুর বিপরীতে হালুয়াঘাটের দক্ষিণে পাকসেনাদের একটি শক্ত ঘাঁটি ভারতীয় আর্টিলারীর সাহায্যে আক্রমণ করা হয়। মুক্তিবাহিনীর তিনটি কোম্পানী যথাক্রমে লেঃ হাশেম, লেঃ কামাল এবং লেঃ তাহের, অপরদিকে ভারতীয় দুটি কোম্পানীর (রাজপুত বাহিনী) সহযোগিতায় আক্রমণে করা হলো। পাকিস্তানীরা একটি কোম্পানী নিয়ে পূর্ণ সামরিক সম্ভারে প্রস্তুত ছিল। আমাদের বাহিনী পাক ঘাঁটি দখল করলেও বেশীক্ষণ অধিকার করে থাকতে পারেনি। পিছন দিক থেকে পাকিস্তানীদের একটি ব্যাটালিয়ান তীব্রভবে আক্রমণ চালালে মুক্তি বাহিনী 'পকেট' ছড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়।

 অক্টোবর মাসের শেষের দিকে নেত্রকোনা এবং কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওড় অঞ্চল আমাদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। আমি চিন্তা করলাম যদি মূল হিসাবে কামালপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল এবং ঢাকাকে টারগেট করি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ময়মনসিংহের পতন হতে বাধ্য। তাই ঐ টারগেটকে সামনে রেখে আমার সামরিক তৎপরতা অব্যাহত রাখলাম।

 অক্টোবর মাসের শেষের মাঝামাঝি থেকে কামালপুর, জামালপুর, বাহাদুরাবাদ ঘাট, বক্সীগঞ্জ এবং চিলমারীতে আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দিই। পাকসেনারাও বিভিন্ন স্থান থেকে সৈন্য নিয়ে এসে ঐসব ঘাঁটিতে মোতায়েন করে প্রতিরক্ষা জোরদার করতে থাকে।

 নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে আমি বেশ আশাবাদী হলাম। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পর্যায়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ভাবনা অনুযায়ী নিয়মিত বাহিনীর একটি ব্রিগেড গঠনের অনুমতি চেয়ে সেনা দফতরে একটি আবেদন পাঠালাম। সেনাবাহিনী প্রধান আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। অথচ এই সময় গেরিলা বাহিনীকে নিয়মিত বাহিনীতে রূপান্তরিত করার উপযুক্ত সময় এসেছিল।

 ১৩/১৪ নভেম্বর ৫টি কোম্পানী নিয়ে ভোর ৩টা কামালপুর আক্রমণ করা হয়। মুক্তিবাহিনীর লেঃ মিজান, ক্যাপ্টেন মান্নান এবং মুক্তিযোদ্ধা সাঈদের তিনটি কোম্পানী এবং ভারতীয় বাহিনীর দুটি কোম্পানী মিলে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। ভারতীয় আর্টিলারী আমাদের সাহায্যে করে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কামালপুর আক্রমণ করে পাকিস্তানীদের হত্যা করা- কামালপুর নয়। আমাদের তীব্র আক্রমণে পাকসেনাদের ২টি কোম্পানী একজন মেজরসহ নিশ্চিহ্ন হয়। আমরা জয়ের আনন্দে অধীর। তখন সময় সকাল ৯টা। গুলির। আঘাতে আমি গুরুতররূপে আহত হই। আমার একটি পা নষ্ট হয়ে যায়। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি। আমার চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা- সাহায্য- সহানুভূতি কোনদিন ভূলবার নয়। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারতরত্ন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পুনা হাসপাতালে আমাকে দেখে নানা কুশল জিজ্ঞাসা করেন। বাংলাদেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত আমি সেক্টরে ফিরে যেতে পারিনি। আমার অনুপস্থিতিতে স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ সেক্টরের দায়িত্ব হাতে নেন।