পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
454

আমরা চিলমারী ছেড়ে চলে আসবো? রাত খুব কাছে থেকে রকেট লাঞ্চার দিয়ে ওয়াপদা ভবনের উপর আঘাত হানার সাথে সাথে সর্বাত্মক আক্রমণ শরু হলো। সমস্ত শত্রঘাটিতে ধবংশযজ্ঞ নেমে এলো। দরপাল্লার কামান গুলো শত্রসেনাদের গানবোটগুলোর সম্ভাব্য অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করে চলেছে। কামানের গোলা, গ্রেনেড, মেশিনগান আর ছোট অস্ত্রের আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে যেতে লাগলো। সকাল ৬টার মধ্যেই গোরগাছা, রাজভিটা, পুলিশ স্টেশন ও ব্রীজের অবস্থানগুলো আমাদের আয়ত্তে আসলো, কিন্তু ওয়াপদা ভবনের আশেপাশের চলাচল আমাদের নজরে পড়লো। আমাদের একমাত্র নির্ভর রকেট লাঞ্চার দুটি শক্র বাংকারগুলিকে নিমূল করতে পারলো না বটে, তবে ওয়াপদা ভবনে অবস্থানরত প্রচুর শত্রসেনা খতম করতে সক্ষম হলো। শুধুমাত্র এ দুটি অস্ত্রের উপর নির্ভর করায় আমরা শত্রর এই অবস্থানটি দখল করতে সক্ষম হলাম না। যেহেতু সম্পূর্ণভাবে শত্রকে আকড়ে থাকতে হলো। কারন একমাত্র রাতের অন্ধকারেই সফল পশ্চাদপসারণ সম্ভব। সকাল ৮ টা। আমার কাছে কবর এলে চাঁদ আরে সাহায্য চাচ্ছে। মনে হলো আবস্থা সংকটজনক। সে লক্ষ করছে বলবাড়ি রেল ষ্টেশন থেকে শত্রসেনারা নতুন আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার ছোট্ট স্পীডবোটটি নিয়ে নদী পার হয়ে চালিয়াপাড়া থেকে গাজীর চরে গিয়ে পৌছলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ বন্দীদের কাছ থেকে খবর বার করার চেষ্টা করছেন। তার ব্যবস্থাপনা মন্দ ছিল না। যাওয়ার সাথে সাথে এক মগ গরম চা পেলাম। আরও জানলাম চাঁদকে সাহায্য করার মত কোন বাড়তি দল রাখা হয়নি। তৎক্ষনাথ আমি আমার ছোট্ট রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে থানা অভিমুখে এগিয়ে গেলাম। ভাগ্যক্রমে আমাদের একটি এল- এম-জি ছিল। এই অস্ত্রটি সেদিন আমাদের ভীষণ উপকারে আসে। নানাদিক থেকে মাঝে- মধ্যেই গোলাগুলি চলছিলো। গ্রামবাসীরা যে যেদিকে পারছিলো দৌড়াচ্ছিল। কেউ কেউ জয় বাংলা জয় বাংলা বলে চিকৎকার করছিলো। থানার এক মাইলের মধ্যে চলে এসেছি, এমন সময় একটি ফেলে যাওয়া গরুর গাড়ী রাস্তার, মাঝখানে পেলাম। গাড়ীতে শুয়ে ছিল একজন মেয়েলোক। একটি হাত ভাংগা, বুকের স্তন নেই। পাকিস্তানী মর্টার শেলের শিকার। তার বাচ্চা ছেলেটি মায়ের রক্তে মাখা, বসে বসে কাঁদছে। এই নিস্পাপ শিশুটি তার মাকে ছেঢ়ে যেতে পারেনি। একজন গ্রামবাসীকে ডেকে জানলাম মেয়েটিকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিলো। থানার পাশইে হাসপাতাল। তার মাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। আর ঐ দিক থেকেই গুলি আসছে। মাই মাকে ছেড়ে সবাই পালিয়েছে। আমি ঐ লোকটিকে গাড়ী চালিয়ে আমার সাথে আসতে বললাম। আমার সাথে থাকায় সে সাহস ফিরে পেলো। হাসপাতালে যখন পৌছলাম গুলি বর্ষণ তখন আরো তীব্রতর হয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের গুলি হাসপাতালের দেয়ালে আঘাত হানছে। ভাগ্যক্রমে হাসপাতালের ভেতর ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ডাক্তারকে পেলাম। আমি সেই হতভাগ্য মেয়েলোকটির ভার ডাক্তারের উপর ছেড়ে দিলাম,— জানি না আজ সে বেঁচে আছে কিনা। হাসপাতাল থেকে বের হয়েই দেখি চাঁদ দৌড়ে আসছে আমার দিকে। সে কাঁদছিলো। আমাকে জানালো, তার দলের ছেলেরা ৭৬ টি দখল করা অস্ত্র এবং প্রচুর গোলাবারুদ ফেলে থানার অবস্থান ছেড়ে চলে এসেছে। তাকে উৎসাহ দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম পূর্ব অবস্থান পূর্ণদখলের জন্য। মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি আমাদের উপর দিয়ে চলে গেল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম পাকিস্থানী সৈন্যরা প্রায় ১০০ গজ দুরে রেললাইনের উপর অবস্থান নিয়েছে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে আড়ালে আমরা এগিয়ে এবং শত্রবাহিনীর একপাশে আমার রক্ষাকারী বাহিনীর এল-এম-জি টি স্থাপন করলাম। একনাগাড়ে গুলি করার পর কিছু পাকিস্থানী সেনা পড়ে গেল। বাকীরা তাদের অবস্থান ছেড়ে রেললাইনের উপরে চলে গেল। তুরিতগতিতে আমরা রেললাইন দখল করলাম। গুলি চালিয়ে আরো কিছু আমাদের উপর গুলি চালালো। আমরা পিছু হটে পুলিশ স্টেশনে অবস্থান নিলাম। সেখানে পাকিস্থানীদের তৈরী পরিখার অভাব ছিল না। দখল করা অস্ত্র এবং গোলাবারুদ গাজীরচরে পাঠানো হলো একটি ঘরে আমি দশ বস্তা চাল ও দুই বস্তা গম পেলাম। চেয়েছিলাম এগুলো গ্রামবাসীরা নিয়ে যাক, কিন্তু নেয়ার মত কেউ সেখানে ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর আমি একজন বুড়ো লোককে পেলাম। আমি তাকে দরকার থাকলে কিছু চাল নিতে বললাম।