পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
23

একজন অধ্যাপক বাংকারের জন্য সি, আই, সিটের বোঝা মাথায় বহন করেছেন চার মাইল পথ অতিক্রম করে টিনগুলো যথাস্থানে নামিয়েই আবার তিনি পেছন দিকে দৌড়ে গেছেন আরেক বোঝা আনতে। ছয় বছরের একটি ছেলেকে দিয়ে কোন কাজ করানো হবে না বলাতে সে সেদিন কেঁদে ফেলেছিলো।

 আমাদের এই অবস্থান গ্রহণ করায় শত্রুর মধ্যে তেমন কোন ত্বরিত প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। তারা হয়তো ভেবেছিলো, এটাও মুক্তিফৌজের এ্যামবুশ ধরনের কিছু একটা হবে তারা মুক্তিবাহিনীকে হটিয়ে দেয়ার জন্য একটি কোম্পানী পাঠায়। কিছুক্ষণের সংঘর্ষে ২৯ জন শত্রুসেনা নিহত হয় এবং অন্যেরা উপায়ান্তর না দেখে পালিয়ে যায়। এমন কি তারা লাশগুলোও নিতে পারেনি ৭ই নভেম্বর দুটি স্যাবর জেট সারাদিন আমাদের অবস্থানের ওপর ট্র্যাপিং করে। এতে আমাদের টিন বহনকারী একজন বেসামরিক লোক নিহত হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, শত্রুরা তেমন ব্যাপক আকারে আমাদের আক্রমণ করতে আসছিলো না। তাছাড়া, উত্তর অংশে পাকিস্তনীদের আমরা যেভাবে ঘেরে ফেলেছিলাম- সেখান থেকে তাদের মুক্ত করারও তেমন কোন চেষ্টাও করছিলো না আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম. পাকিস্তানীরা এতদিনের আক্রমণাত্মক ব্যবস্থার পরিবর্তে এখন আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এ সময়ে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানীদের একটি অয়্যারলেস বার্তা আমরা ‘ইণ্টারসেপ্ট’ করি। সেটা ছিলো- “বেলুনিয়া থেকে নিজেরাই পালাবার ব্যবস্থা করো”।

 কয়েকজন শত্রুসেনা আমাদের ব্যূহ ভেদ করে পালাবার চেষ্টাও করেছিলো, কিন্তু তারা আমাদের গুলিতে নিহত হয়। ১১ই রভেম্বরের মধ্যে আমরা অবশিষ্ট শত্রুসেনাদের ধ্বংস করে ফেলি। বেশ কিছু পাকিস্তানী আমাদের হাতে বন্দী হয়।

 যুদ্ধবন্দীদের কাছ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুর্ভাগ্যের কথা আমরা জানতে পারি। সর্বত্রই শত্রুসৈন্যদের একটা সাধারণ অভিযোগ ছিলো যে, অফিসাররা তাদের সাথে ফ্রণ্ট লাইনে থাকতো না। শুধু গোলাগুলি ছাড়া অন্য সবকিছুরই অভাব ছিলো। তাদের তিক্ত অভিযোগঃ “এমন কি খাদ্যের জন্যও আমাদেরই ব্যবস্থা করতে বলা হতো।” প্রতিটি সেক্টরে যুদ্ধবন্দীদের কাছে এবং মৃত সৈনিকদের পকেটে অনেক চিঠি পাওয়া গেছে। এগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের মা-বাবা আত্মীয়স্বজনের কাছে লেখা। কিন্তু পাঠাতে পারেনি। এসব চিঠিতে তাদের করুন অবস্থা এবং প্রতিটি স্তরে শৃংখলার কাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ার এক করুণ চিত্র পাওয়া যায়। এই ছিলো তাদের সাফল্য- মাসের পর মাস দস্যুবৃত্তি, পাশবিক অত্যচার এবং যাবতীয় জঘন্য অপরাধের উপযুক্ত পুরস্কার। একজন সিপাই তার বাবাকে লিখেছেঃ “গত মাসে এগারোশত টাকা পাঠিয়েছি, বোধহয় পেয়েছেন। দুদিন যাবৎ অজ্ঞাতপরিচয় এক স্থান অভিমুখে আমরা চলেছি। গতকাল মুক্তিবাহিনীর হামলার মুখে পড়েছিলাম। এতে আমাদের প্লাটুনের দু'জন মারা গেছে। এর আগে খালের পানিতে পড়েও একজন মারা যায়। এখানে ভীষণ বৃষ্টি হয়। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু বড় বড় নদী আর পুকুর।

 লোকজন ভয়ে আমাদের কাছে ঘেঁষতে চান না। গ্রাম থেকে আমরা খাবার সংগ্রহ করি, কিন্তু এরজন্য কোন দাম দেই না। আমাদের অফিসাররাও কোন দাম দেয় না। আমরা এখন একটি গ্রামে বিশ্রাম নিচ্ছি। কাল সকালেই আবার রওয়ানা হতে হবে। রাতে চলাফেরা করতে পারি না। এখানে অনেক মুক্তিফৌজ। আমি পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী হওয়ার জন্য দরখাস্ত করেছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।”

 পরদিন ভোরই মুক্তিবাহিনী এই প্লাটুনটি অ্যামবুশ করে। ফলে দলের আরো দশজন সৈন্য মারা যায়। নিহতদের একজনের পকেটেই চিঠিটি পাওয়া গিয়েছিল।

 আমরা বেলুনিয়া অভিযানের আয়োজন করেছিলাম ৪ঠা নভেম্বর। অর্থাৎ এই তারিখ থেকেই সীমিত এবং স্থানীয় পর্যায়ে হলেও, ভারতীয়রা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। আর ৫ই নভেম্বর শুরু হয়ে যায় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার অঘোষিত যুদ্ধ।