পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
459

এজন্য আমি এক কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধাকে মহেন্দ্রগঞ্জে ক্যাম্পে তৈরী হওয়ার নির্দেশ দিই। নিরাপত্তার খাতিরে এই কোম্পানীকে কি কাজ করতে হবে তা জানতে দিইনি। সে সময় সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিল বিভিন্ন শ্রেণীর লোক। নিরাপত্তা বজায় রাখা তখন একটি দুরুহ ব্যাপার।

 সন্ধার পূর্বে কোন আক্রমণ পরিচালিত হবে না বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম। আরও বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় হাতে রয়েছে। তাই দুপুর বেলা মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে ১৮ মাইল দূরে মাইনকারচর সাবসেক্টরের দিকে রওনা হয়ে যাই- অপর একটি মুক্তিবাহিনী দলকে তাদের অভিযান সম্পর্কে নির্দেশ দেয়ার জন্য। মাইনকারচরে পৌঁছার সংগে সংগে আমি খবর পাই যে, ধানুয়া ও ঘাসীগ্রামে আমদের অবস্থানগুলো পাকিস্তানীরা আক্রমণ করছে। এ খবর পেয়েই আমি মহেন্দ্রগঞ্জে ফিরে আসি। বেলা তখন সাড়ে চারটা। ক্যাম্পে পৌঁছে যে কোম্পনীটিকে তৈরী থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম তাদের খোঁজ করি। আমার অনুপস্থিতিতে পাকিস্তানী আক্রমণের খবর পেয়ে এই কোম্পানীটিকে আমাদের অবস্থানগুলোর সুদৃঢ় করার জন্য প্রেরণ করা হয়। কোম্পানীটিকে এভাবে পাঠাবার ফলে আমার পরিকল্পনা আংশিকভাবে বানচাল হয়ে যায়। সেই সময় কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কামালপুর ঘাঁটিটি আক্রমণ করলে তা সহজেই দখল করা যেতো।

 কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণের কোন উপায় না দেখে আমি ধানুয়া কামালপুরের দিকে রওনা হয়ে যাই। পথে দেখি ছোট ছোট দলে পথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের জোয়ানরা মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পের দিকে ফিরে আসছে। তাদেরকে পূর্বস্থানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমি ঘাসীরগ্রামে পৌঁছি। তখন প্রায় সন্ধা। পৌঁছে দেখি বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোম্পানীটি বিশৃংখলভাবে তাদের অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী একজন সঙ্গীসহ তখনও সেখানে রয়ে গেছেন। জলোমাঠটির মাঝামাঝি জায়গা থেকে তখনও পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের নিহত এবং আহত সৈন্যদেরকে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। ধানুয়া কামালপুরের অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধরা তখনও অটুট রয়েছে।

 সেদিন বেলা আড়াইটার সময় আমার মহেন্দ্রঞ্জ ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার পর পরই কামালপুর থেকে আনুমানিক দুই কোম্পানী সেন্য আক্রমণ ধারা রচনা করে ঘাসীরগ্রামের দিকে এগোতে থাকে। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোম্পানীটি উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে শত্রু আসার পূর্বেই গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানী সৈন্যরা এই গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে নানা যুদ্ধাস্ত্র সহকারে বেপরোয়াভাবে এগোতে থাকে। তাদের পাল্টা গুলিতে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একজন নায়েক সুবেদার ও অপর একজন জোয়ান নিহত হন। সে সময় পেছন দিকে কেউ চিৎকার করে বলে যে, বকশিগঞ্জ থেকেও সৈন্যদল তাদের আক্রমণ করতে আসছে। এতে কোম্পানীটিতে চরম বিশৃংখলা দেখা দেয় এবং তারা নিজ স্থান ছেড়ে পলায়ন করে। এসময় ধানুয়া কামালপুরের দক্ষিণ দিকে ছিল আমাদের একটি এল- এম-জি। এই এল-এম-জি'র কোনাকুনি গোলাবর্ষণে বহুসংখ্যক আক্রমণরত পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয় এবং শেষ পর্যায়ে তারা হটতে বাধ্য হয়। যে মুক্তিযোদ্ধা এল-এম-জি চালাচ্ছিল, উত্তেজনা বশত সে এল- এম-জি'র ব্যারেলটি বাম হাতে চেপে ধরে রাখে। এতে তার হাতের তালু সম্পূর্ণরূপে পুড়ে যায়। বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হত্যা এবং আক্রমণকারী বাহিনীকে পিছু হটিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব তারই। সন্ধ্যার পর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে আমি নির্দেশ দিই তার কোম্পানীটিকে পূর্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। রাত ন'টার সময় বোঝা গেল কোম্পানীটির মনোবল ভেঙ্গে গেছে। তাই তাদের ঘাসিরগ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাদের জায়গায় পাঠানো হল আর একটি মুক্তিবাহিনী কোম্পানী। এই অভিযানটিতে যদিও আমাদের অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে তথাপি পরিকল্পনার দিক থেকে এর মূল্য অপরিসীম। এই অভিযানকে একটি সুপরিকল্পিত এ্যামবুশও বলা চলে। শত্রুকে প্রলুব্ধ করে জলোমাঠিটিতে এনে বিপুল সংখ্যায় হত্যা করতে আমরা সমর্থ হয়েছিলাম। এই অভিযানটির পর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও আত্মনির্ভরতা বহুগুণ বেড়ে যায়। হত্যা কথাটি আমি বারবার ব্যবহার করেছি। অবশ্য নিয়মিত যুদ্ধে এই শব্দটির বিশেষ ব্যবহার নেই। শত্রুকে পরাজিত করাই মূল উদ্দেশ্য। গেরিলা যুদ্ধে চিহ্নিত শত্রুমানবিক প্রশ্নে বড় অপরাধী। হত্যাই তার যোগ্য শাস্তি।