পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
468

পেরেণ্টস কলকাতার দিকে গেছেন। তখন আমি জেঃ জিয়ার কাছে ক'দিনের ছুটি প্রার্থনা করি। তিনি আমার ছুটি মঞ্জুর করেন। আমি কলকাতা চলে যাই। সেখানে ৪/৫ দিন থাকার পর জেনারেল ইসলামের কাছে খবর পাই যে, সমস্ত সেক্টর কমাণ্ডার ৮ থিয়েটার রোডে কনফারেন্স ডাকা হয়েছে এবং জেনারেল জিয়াও কনফারেন্সে আসবেন। ঐ কনফারেন্সে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরসমূহের রুপরেখা ও নানাবিধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এরপর আমি আমার ১নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ইউনিটে ফিরে আসি। তারপর শুনতে পাই যে ১১ নং সেক্টর নামে একটি নতুন সেক্টর গঠিত হয়েছে যার হেড কোয়ার্টার মহেন্দ্রগঞ্জে।কর্নেল তাহের সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব নেন। আমি যেহেতু অসুস্থ ছিলাম তাই আমাকে দুই নং সাবসেক্টরে দেওয়া হয়। সেক্টর এক্সিকিউটিভ হিসাবে আমি দায়িত্ব ভার গ্রহণ করি।

 এই সেক্টরে আমার যোগদান করা থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ছোট বড় উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোই আমি বলবো।

 কামালপুরে পাকিস্তান আর্মির যে ঘাঁটি ছিল তা অত্যন্ত সুদৃঢ় ছিল। ঐ ঘাঁটির সমস্ত বাংকারগুলো ছিল সিমেণ্টের আর-সি-সি বাংকার। কমিউনিকেশন ট্রেঞ্চ দিয়ে সেগুলো কানেক্টেড ছিল। কামালপুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। তাই তারা এটাকে খুব শক্ত করেছিল, কারণ কামালপুরে যোগাযোগ বিস্তৃত ছিল বক্সিগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, মধুপুর হয়ে ঢাকা পর্যন্ত। তাই এই সেক্টর পাকিস্তানীদের কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমনি আমাদের দিক থেকেও ছিল গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। পাকিস্তানীরা জানতো এই সেক্টরে তাদের পতন হলে ঢাকা পৌঁছা তাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়বে। আমি আমার সহকর্মীদের বলেছিলাম, কামালপুরের পতন হলে সাতদিনের ভিতর ঢাকার ও পতন ঘটবে। মূলতঃ কামালপুরের পতন হলো ৪ তারিখ বিকেলে এবং এর কয়েক দিনের মধ্যে ঢাকার ও পতন হলো। এই বাহিনীর ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগলো ৭/৮ দিনের মত। উল্লেখ্য, কামালপুরে যে ট্রুপস ঢুকেছিল তারাই প্রথম ঢাকা পৌঁছেছিল। কামালপুরে যুদ্ধে পাকিস্তানীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। অবশ্য তারা যুদ্ধের ব্যাপারে প্রচুর মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল। তাদের প্রচারাণার এক-দশমাংশ সম্ভবত সত্য।

 আমি এই সেক্টরে যোগদানের পর আরও অনেক ঘটনা বা যুদ্ধ হয়, যেমন ধানুয়া কামালপুরের যুদ্ধ। ধানুয়াকামালপুর কামালপুরের পরেই একটি গ্রাম। এই গ্রামটির কণ্টিনিউয়েশান ভারত সীমান্তের ওপারের গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। সীমিত হাতিয়ার নিয়ে যেহেতু আমার পাকিস্তানীদের সুগঠিত ক্যাম্প থেকে উৎখাত করতে পারছিলাম না তাই বিকল্প পন্থায় ধানুয়া কামালপুর থেকে এ্যামবুশ করার চেষ্টা করছিলাম একটা ডিফেন্স নিয়ে। এই ধানুয়াকামালপুর একটা কণ্টিনিউয়েশান ছিল ফিরোজপুর হয়ে বক্সিগঞ্জের দিকে। এই পথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমি ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে ৬/৭ খানা পাকিস্তানী আর্মির গাড়ি মাইনের সাহায্যে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিলাম। বক্সিগঞ্জ থেকে কামালপুরের দুরুত্ব ৭ মাইল। পরবর্তী পর্যায়ে তারা কোনো গাড়ী নিয়ে কখনো মাইনের ভয়ে এই দূরুত্ব অতিক্রম করতে পারেনি। অতিক্রম করতে চাইলেও গরু কিংবা মহিষের গাড়ী দিয়ে আগে পথ পরীক্ষা করে নিতো। তারপরও পরীক্ষিত পথে তারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। আমার মনে আছে, একদিন আমরা ছোট একটি দল নিয়ে কামালপুর এবং বক্সিগঞ্জের মাঝখানে এ্যামবুশ লাগিয়ে পাকিস্তানীদের অপেক্ষায় বসে ছিলাম। কামালপুরের পাকিস্তানীদের জন্যে খাবার-দাবার সরবরাহ হতো বক্সিগঞ্জ থেকে। এ পথে সন্দেহজনক এক লোক যাওয়ার সময় আমরা তাকে ধরি এবং এক অফিসারের জন্যে প্রেরিত খাবার-দাবার এবং পাকিস্তানীদের কিছু চিঠিপত্র হস্তগত করি। উর্দু- ইংরেজীতে লেখা ঐসব চিঠির পাঠ উদ্ধার করে আমরা জানতে পারি দিন আর বেশী নয়, তারা হ্যাণ্ডসআপ করবে।

 আরও একটি ঘটনা- তারিখ ঠিক মনে পড়ছে না। সেদিন আমরা ৬০/৭০ জনকে নিয়ে আখক্ষেতের ভিতর ডিফেন্স নিয়েছি। পাকিস্তানীরা বেরিয়ে আসে। তাদের সাথে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। এতে পাকিস্তানীদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমার দুই জনের একটা ছোট্ট দল ছিল। তাদের নাম মনে পড়ছে না। ১১ নং সেক্টরের ১১৩ জনের যে লিস্ট আছে তাদের কেউ হবেন। তারা ট্রেঞ্চের পিছনে বসা ছিল। সেখান থেকে তারা