পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
469

পাকিস্তানীদেরকে আক্রমণে ব্যস্ত ও মরীয়া হয়ে উঠেছিল। এক পর্যায়ে বুলেট শেষ হয়ে গেলে এরা পাকিস্তানীদের হাতে মারা যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানীদের মত লাস্ট বুলেট এরা লড়াই করেছিল। এদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে সামরিক মর্যাদায় দাফন করি। এদের স্মৃতিফলক বর্তমান।

 ধানুয়া কামালপুরে আমরা যে ডিফেন্স নিয়েছিলাম তার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা সেপ্টেম্বর মাসের কোন সময়ে ঘটেছিল। সেটা পরিচালনা করেছিলেন প্রথম বেঙ্গলের একটি কোম্পানী। অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন। তার সাথে অফিসার ছিল বর্তমান কর্নেল পাটোয়ারী। তারা ধানুয়াকামালপুরে ডিফেন্স নিলেন। পাকিস্তানীরা এসে আক্রমণ করে, ফলে প্রচণ্ড সংঘর্ষ বাধে। পাকিস্তানীদের প্রায় ৩০/৪০ জন মারা যায়, আমাদের পক্ষে মাত্র একজন আহত হয়। পাকিস্তানীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেই অপারেশনে আমরা পাঞ্জাবীদের একটা মৃতদেহ নিয়ে আসতে সক্ষম হই। মৃতদেহের কপালে গুলি লাগে। এই মৃতদেহ আমাদের সকল সৈন্যকে দেখানো হয়। ফলে তাদের মনোবল বেড়ে যায়। অবশ্য পরে মুসলমান হিসেবে কবর দেওয়া হয়। পরে আমরা যখন ফিরে যাই তখন শুনতাম পাকিস্তানীরা কার নাম ধরে ডাকছে। সম্ভবতঃ মৃত লোকটিরই।

 এ ছাড়াও কামালপুরে এমন কোন দিন ছিল না যে পাকিস্তানীরা শান্তিতে বসবাস করতে পারতো। কামালপুর-বক্সিগঞ্জে পাকিস্তানীদের যে টেলিফোন যোগাযোগ ছিল তা আমরা কেটে দিতাম। এক পর্যায়ে ১০/১২ জনের একটা ছোট দলকে এ ধরনের অপারেশনে পাঠাই। তারা প্রথমে টেলিফোনের তার কেটে দিয়ে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। পরে যখন পাকিস্তানীদের তার ঠিক করার পার্টি আসে তখন তাদের উপর আক্রমণ করে বসে। গোলাগুলি করে। পাকিস্তানীদের ক্ষতিসাধন করে ফিরে আসে। আমাদের কোন ক্ষতিই হয়নি।

 আরও একটি ঘটনা। অক্টোবর মাসের কোন এক সময় ইণ্ডিয়ান আর্মির একটি ব্যাটালিয়ন দিয়ে পাকিস্তানীদের উপর আক্রমন চালানো হল। সেই আক্রমণে ইণ্ডিয়ার একটি কোম্পানী কামালপুরের একটু পিছনে এ্যামবুশ করে। যখন তাদের উপর আক্রমণ চলছিল তখন মুক্তিযোদ্ধাদের দু'টি কোম্পানীও তাদের সাথে ছিল। কামালপুরের ফোসকে সহায়তা করার জন্য বক্সিগঞ্জ থেকে মর্টার নিয়ে তিনটি পাকিস্তানী গাড়ী আসছিল। তখন রাস্তায় এ্যামবুশ করে গাড়ী সমেত পাকিস্তানীদের খতম করা হয়।

 তারপর সম্ভবতঃ নভেম্বর মাস হবে। ইণ্ডিয়ান আর্মির মাউণ্টেন বিগ্রেডের একটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে কামালপুর আক্রমণ করানো হয় এবং একটি ব্যাটালিয়ন দিয়ে কামালপুর- বক্সিগঞ্জের মাঝে এ্যামবুশ লাগানো হয়। আমাদের দু'টি কোম্পানী। একটির কমাণ্ডার আমি নিজে, সেটা নিয়ে আমি একটা ব্লকিং পজিশন তৈরী করি। সেটা কামালপুর মেইন পজিশন থেকে প্রায় ১৫০ গজ দুরে। আমার বিপরীতে ছিলেন বর্তমান মেজর মিজান। তার কোম্পানী সমেত তাঁকে নিয়ে একটি ব্লকিং পজিশন তৈরী করা হয়। আমাদের উপর নির্দেশ ছিল আমরা আখ ক্ষেতের ভিতর ট্রেঞ্চ খুঁড়ে পজিশন নিয়ে বসে থাকবো, যেন পাকিস্তানীরা এই দিক থেকে পালিয়ে যেতে না পারে। যখন আমরা এই পজিশনে পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। আমাদের সাপোর্টে ছিল ইণ্ডিয়ান একটি আর্টিলারী রেজিমেণ্ট এবং একটি মর্টার বাহিনী। তারা কামালপুরের উপর শেলিং করছিল। সকালের দিকে যোগাযোগের জন্য আমাদের কাছে ছোটছোট অয়্যারলেস সেট দেয়া হয়। কর্নেল তাহের থাকলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের সঙ্গে যিনি ৯৫ মাউণ্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেড কমাণ্ডার ছিলেন। ওখানে তিনি তাদের সাথে এই অপারেশনটা কো-অর্ডিনেশন করছিলেন। আমি যখন আমার পজিশনে পৌঁছে গেলাম তখন ছিল সকাল সাড়ে চারটা। তখন ইণ্ডিয়ান আর্টিলারী ফায়ার করছিল। বেশ কতগুলো আর্টিলারী শেল আমাদের পজিশনের উপর এসে পড়লো। আরা এই কোম্পানীতে মোট ১০৯ জন ছেলে ছিল। তার মধ্যে ৯ জন আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল। এরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এলোপাতারি দৌড়াদৌড়ি করে পালিয়ে যেতে লাগলো। মাত্র ক'জন ছেলে নিয়ে আমি সেই পজিশনে পৌঁছালাম। তারপর অয়্যারলেস সেটে কর্নেল তাহেরের সাথে যোগাযোগ করি এবং আমাদের পজিশনের উপর শেলিংয়ের বিস্তারিত ব্যাপার তাকে জানাই এবং ফায়ারিং বন্ধ করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলাম। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না ফায়ারিং কোন পক্ষের, কারণ এই পজিশনের ওপর ফায়ার