পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
25

করে। পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে ট্যাংক বহরও ছিল। প্রথম দফায় পাকিস্তানীদের ৮০ জন সৈন্য ও চারটি ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয়। পরের দিন দ্বিতীয় দফা হামলার সময় তিনটি পাকিস্তানী ট্যাংক আটক করা হয় এবং তাদের বহুসংখ্যাক সৈন্য প্রাণ হারায়। ভারতীয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক। এবার ভারতীয়রা প্রতিশোধ নিয়ে এগিয়ে আসে বিপুল শক্তিতে। তারা আন্তর্জাতিক সীমারেখা পার হয়ে বাংলাদেশের ভেতর কয়েক মাইল ঢুকে পড়ে। ভারত সরকার আগেই তার সৈন্যদের সীমান্ত এলাকায় সীমিত আকারে অভিযান পরিচালনার আদেশ দিয়ে রেখেছিলেন। নির্দেশ ছিল, সীমান্তের ওপার থেকে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার হুমকি দেখা দিলে সৈন্যরা তা নির্মূল করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে। ভারত তখন শুধু তার সীমান্ত রক্ষাই নয়, প্রয়োজন দেখা দিলে সমুচিত প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যও পুরোপুরি প্রস্তুত।

 পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেণ্ট রিচার্ড নিক্সন প্রস্তাব দেন যে, ভারত এবং পাকিস্তান দুই পক্ষকেই সীমান্ত এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। ইয়াহিয়া খান বাহ্যত প্রস্তাবে সম্মতি জানান। অপরপক্ষে ভারত এই শর্তে সম্মত হয় যে, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানকে তার সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। সকল সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর কার্যকলাপ এবং এদেরকে সরিয়ে নেয়া না হলে এই অঞ্চলে শান্তি আসবে না। এই সব প্রস্তাব যখন আদান-প্রদান হচ্ছিলো পাকিস্তান তখন পশ্চিম ফ্রণ্টে রাতের অন্ধকারে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে সৈন্য সমাবেশ করে। এ ঘটনা ১লা ও ২রা ডিসেম্বর। ২রা ডিসেম্বরেই পাকিস্তান সংঘর্ষের বিস্তৃতি ঘটানোর অসৎ উদ্দেশ্য মরিয়া হয়ে আগরতলার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গোলাবর্ষণ করে। এদিন নয়াদিল্লীতে কংগ্রেসে কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতাকালে মিসেস গান্ধি স্পষ্ট কণ্ঠে ঘোষণা করেন, তথাকথিত বৃহৎ শক্তিবর্গ যেভাবে চাইবে সেভাবে কাজ করার দিন শেষ হয়ে গেছে। ভারতের স্বার্থ যাতে রক্ষিত হয় সেই দিকে, দৃষ্টি রেখে আজ আমাদের কাজ করতে হবে।

 অক্টোবর মাসেই জম্মু কাশ্মীরের পুঞ্চ সেক্টরে পাকিস্তানীদের প্রথম যুদ্ধপ্রস্তুতি লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানের সমরপ্রস্ততি এবং তৎসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থার ক্রম অবনতি এবং কোটি কোটি বাঙালীর চরম দুর্দশার প্রতি বৃহৎ শক্তিগুলোর উদাসীনতা লক্ষ্য করে ভারত সরকার তখনই তাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সম্ভাব্য আপৎকালের জন্য পুরোপুরি হুঁশিয়ার থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান এর আগে তিনবার ভারত আক্রমণ করেছে সে কথা ইন্দিরা গান্ধী ভুলে যাননি।

 ভারতের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধে পাকিস্তান পশ্চিম ফ্রণ্টে প্রথম অভিযানেই রাজনৈতিক এবং রণকৌশলের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ যতোদূর সম্ভব বেশী এলাকা দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিলো। পাকিস্তানের মূল পরিকল্পনায় ছিলো, একটি সাঁজোয়া হিভিশন এবং দুটি পদাতিক ডিভিশন এগিয়ে গিয়ে ভারতের ওপর হামলা চালাবে। দরকার হলে আক্রমণকারী ডিভিশনগুলোর শক্তি বৃদ্ধির জন্য আরো পদাতিক ও সাঁজোয়া বাহিনীর সৈন্য পাঠানো হবে। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্তিত পাক সেনাবাহিনীর বাকি অংশের দায়িত্ব ছিল সমস্ত বরাবর ভারতীয় বাহিনীকে স্থানীয়ভাবে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে ব্যস্ত রাখা। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে অনেকগুলো প্রলুব্ধকারী হামলার পরিকল্পকারী করা হয়। পাকিস্তানীরা আশা করেছিল এইসব প্রলব্ধকারী হামলায় বিভ্রান্ত হয়ে ভারত তার সেনাবাহিনীকে বিশেষ করে সেনাবাহিনীর শক্তিশালী রিজার্ভ বাহিনীকে মূল রণাঙ্গন থেকে অন্য কোনো ক্ষেত্রে নিয়োজিত করে ফেলবে। ফলে পাকিস্তানের মূল আক্রমণকারী বাহীনীর পক্ষে অতি সহজে এবং স্বল্প প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনা এবং জয়লাভ করা সম্ভব হবে।

 এই লক্ষ্য সামনে রেখে পাকিস্তান তার ১২ পদাতিক ডিভিশনের ওপর পুঞ্চ এলাকা দখল করার দায়িত্ব অর্পণ করে। পাকিস্তান আশা করেছিল, পুঞ্চ এলাকায় হামলা চালালে জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত ভারতীয় বাহিনী এ এলাকাতে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে ফলে তারা আর চেনাব নদীর দক্ষিণে যাবার সুযোগ পাবে না। সেই ফাঁকে পাকিস্তান চেনাব নদীর দক্ষিণে তার মূল হামলা চালিয়ে সফল হবে। এখানে উল্লেখযোগ্য, পাকিস্তানের এই ডিভিশনটি কাশ্মীরেই অবস্থান করেছিলো এবং এর অধিকাংশ সৈন্য কাশ্মীরেরই লোক।