পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
484

সময় ঝুপ করে একটি শব্দ হলো, মনে হলো একটি লোক নালার ভিতর দিয়ে পালাচ্ছে। আমার সেকশন কমাণ্ডাররা জড়সড় হয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে পজিশনে গেল। দেখে জ্বলে গেলো। আসলে তাদের আরো ছড়িয়ে পড়ে একে অপরের বিপরীত দিকে মুখ খরে (ডায়মণ্ড ফর্মেশন) অলরাউণ্ড ডিফেন্স নেওয়া উচিত ছিল। বুঝলাম আরো অনেক ট্রেনিং-এর দরকার। ভাগ্যিস ঝুপ করে আওয়াজ হয়েছিল নালাতে পাড় ভেঙ্গে ধসে পড়া মাটি থেকে। তা না হলে গোল হয়ে বসে থাকা আমার দলটিকে নিমেষের মধ্যে শেষ করে দেয়া একজন শত্রুসৈন্যর পক্ষেই যথেষ্ট ছিল। ফেরত আসার সময় একটি গারো মেয়ে আমাকে দেখে চুপ করে পাহাড়ের গাছের সাথে মিশে রইল। আমি ধারণাই করতে পারিনি যে অমন ফাঁকা জায়গায় কোন মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে।

 ২রা আগস্ট বিকালে কর্নেল জিয়াউর রহমান স্বচক্ষে আমার প্ল্যান মোতাবেক হাতিয়ারের অবস্থানগুলো দেখলেন। রাতে রাস্তা থেকে গাড়ী পড়ে যাওয়াতে তখন বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় তখন ব্রিগেড হেড- কোয়ার্টারে ১ম ইস্ট বেঙ্গল ক্যাপ্টেন মাহবুব (যিনি পরে ৮ই ডিসেম্বরে সিলেট রণাঙ্গণে শহীদ হন) আমাকে বললেন, “স্যার মনে কনফিউশন থাকলে এ্যাটাক করতে যাবেন না।” আমি হেসে বললাম, “বেওকুফের মত মরতে আমি রাজী নই।” ৩রা আগস্ট রাত ১২টার দিকে এসেম্বলী এরিয়া থেকে রওনা হবো-দেখি বাহাদুরাবাদ ঘাটে বিজয়ী বীর কর্নেল শাফায়াত জীপ নিয়ে হাজির-“আমিন, রিমেম্বার, ডোণ্ট গো ফর ইমপসিবল টাস্ক অল বাই ইওরসেলফ-অল দি বেস্ট।

 এসেম্বলি এরিয়া থেকে আমার সৈন্যরা অত্যন্ত সাবলীল গতিতে এফ-ইউ-পিতে পৌঁছায়। এমনকি মাঝপথে নালা ক্রস করার সময়ও কোন শব্দ করেনি, কারণ পূর্ববর্তী দু'রাত বিনা শব্দে পানির উপার চলার প্র্যাকটিস করেছিলাম। অন্যদিকে একই সময়ে দুই প্লাটুন রাংগাটিয়াতে যায় কার্ট-আপ পার্টি হিসাবে। যদিও ই-পি-আর’ও গার্ড ছিল তথাপি মনে হয় এফ-ইউ-পি মার্কিং করলে যে সামান্য বিশৃংখলাটুকু হয়েছিল তাও হত না। সৈন্যরা যখন এফ-ইউ-পি'তে যাচ্ছে আমি তখন ৮/১০ জ এফ-এফ ছাত্র নিয়ে এম-জি ও আর- আর'এর এম্যুনিশন বাংকারে পৌঁছিয়ে দিই। উদ্দেশ্য, ওদের মনে সাহস যোগানো। কারণ যুদ্ধের ফলাফল এদের উপর অনেকখানি নির্ভর করছিল। বাংকারের পিছে অবস্থানরত সুবেদার হাকিম তখন রীতিমহত ক্ষেপে গেছেন, কারণ ইন নিজে তো খাবার পাননি, নিজের ছেলেরা যারা সারারাত ঐ আড়াইমণী বস্তায় বালি ভরে বাংকার বানিয়েছে ওরাও পায়নি। দেমাক ঠাণ্ডা রেখে বললাম “সব ভুলি নাই, তবে আপনাদের রুটি পিছনে এসেম্বলী এরিয়াতে রয়ে গেছে, কাউকে পাঠিয়ে দিয়ে নিয়ে আসুন।” এফ-ইউ-পি'তে আমার কমাণ্ডিং অফিসার মেজর আমিন আমাকে একাকী শত্রুঅভিমুখে ঠেলে না দিয়ে আমার সাথে নিজেও যেতে চাইলেন। আমি সেই দুঃসাহসিক বীর যোদ্ধাকে ইকনমির কতাটা বুঝাতে চাইলাম। নিছক ভাবাবেগে কাজ হবে না- এক সংগে দুজন অফসার হারানো মুক্তিবাহিনীর নিছক বোকামি। রাত ৩-৩৫ মিনিটে এফ-ইউ-পি'তে পজিশন নিলাম। আমার ডানে ১২ নং প্লাটুন আমার এক ভাগ্নে আই-এ ক্লাশের ছাত্র জহিরুল আনোয়ার ওরফে সানু সাধারণ সৈনিক হিসেবে আমার পাশেই ছিল। আশ্চর্য, আজ আত্মীয়তার প্রশ্নটা তেমন করে দেখা দিচ্ছে (যেহেতু স্বজনপ্রীতি আমাদের মজ্জাগত হয়ে আছে) সেদিন কিন্তু এ প্রশ্নটা তেমন করে দেখা দেয়নি। সেদিন প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বঝংকৃত হয়েছিল- “ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার”। তাই বুঝি ঘূণাক্ষরেও যুদ্ধের ময়দানে আমার ভাগ্নের উপস্থিতি আমি টের পাইনি।

 এফ-ইউ-পি'তে পজিশন নিয়ে ৩-৪৫ মিনিটে অয়ারলেসে বললাম “জোরে মার।' সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আর্টিলারী গর্জে উঠলো। বুঝতে পারলাম আর্টিলার আওয়াজের ধমকে আমার স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিকরা এফ-ইউ-পি'তে মাটির সাথে মিশে যেতে চাইছে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকাটা আরো প্রকট হয়ে উঠলো যখন নিজেদের এই প্রি-এইচ আওয়ার আর্টিলারী গোলাবর্ষণ কালে দু'তিনটি রাউণ্ড ভুলবশত ঠিক আমাদের এফ-ইউ-পি'তে এসে পড়ে-যদিও বা টারগেট থেকে এফ-ইউ-পি ছিল প্রায় এক হাজার গজ দূরে। মনে হয়, এফ-ইউ-পি, শত্রুশিবির ও আমাদের আর্টিলারী পজিশন এক লাইনে ছিল বলে সহজে আর্টিলারীর গোলা এসে এফ-ইউ-পি'তে