পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
26

পাকিস্তানে আরো পরিকল্পনা করেছিলো যে রাভী নদী বরাবর সুদৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করে তারা নওশের- রাজৈরি এলাকা দখল করে ফেলবে। এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হলো গুজরাটে অবস্থিত ২৩ পদাতিক ডিভিশনকে।

 ১নম্বর কোরের ওপর দায়িত্ব দেয়া হলো সাকারগড় এলাকায় ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার। প্রলুব্ধকারী হামলা চালিয়ে ভরতীয় বাহিনীকে ঐ এলাকায় যুদ্ধে নামাবার পরিকল্পনা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল আসল আক্রমণ এলাকা সম্পর্কে যেন ভারত কিছুই বুঝে উঠতে না পারে।

 লাহোর এবং কাসুর সোলেমানকি এলাকায় ৪ নম্বর কোরকে ইরাবতী এবং গ্রাণ্ড ট্র্যাংক রোডের মধ্যবর্তী চানগানওয়ালা নালা পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল রক্ষা করার দায়িত্ব দেয় হয়। রহিম ইয়ার খান এবং করাচীসহ কচ্ছের রানের মধ্যবর্তী এলাকা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয় ১৮ পদাতিক ডিভিশনের ওপর।

 ইয়াহিয়া খান চেয়েছিলেন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ভূখণ্ড বিশেষ করে জম্মু কাশ্মীর সেক্টরের বেশ কিছু এলাকা প্রথমেই দখল করে ফেলতে। যুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের কোন জায়গা খোয়া গেলে ভবিষ্যতে তা উদ্ধারের জন্য পশ্চিমাঞ্চলের এই দখলকৃত জায়গার বিনিময়েও তিনি দর কষাকষি করতে পারবেন, এই ছিলো তার আশা।

 লক্ষ্য অর্জনের জন্য পশ্চিমাঞ্চলে তাকে প্রথমেই আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে হবে এবং পূর্বাঞ্চলে জেনারেল নিয়াজীকে রাখা হবে আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা।

 পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার ইস্টার্ন কমাণ্ড অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য সীমিত সংখ্যক আক্রমণাত্মক অভিযানসহ প্রধানত আত্মরক্ষামূলক তৎপরতার ভিত্তিতে একটি পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলো। গুটিকয়েক আক্রমণাত্মক অভিযানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল শুধু যুদ্ধটাকে ভারতের মাটিতে গড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য।

 বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সীমান্তে রেখার যতো কাছে অবস্থান দেয় যায় ততদূর পর্যন্ত এলাকা নিয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়।

 ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার যতোগুলো পথ রয়েছে সেই সবগুলো পথেই এই ধরনের সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং যোগাযোগ কেন্দ্র যেমন চট্টগ্রাম, ফেনী, লাকসাম, চাঁপুর, কুমিল্লা, আখাউড়া, দাউদকান্দি, ভৈরব, ঢাকা, খলনা, যশোর, ঝিনাইদহ এবং বগুড়ার চারপাশে চুড়ান্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেয়া হয়। যে কোনো মূল্যে ঢাকাকে রক্ষা করাই ছিল পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।

 এই ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে পাল্টা আঘাত (কাউণ্টার অ্যাটাক) হানার জন্যেও প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পাকিস্তান ইস্টার্ন কমাণ্ডের এই বিস্তারিত রণপরিকল্পনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সফরকালে অনুমোদন করেছিলেন। পরিকল্পনা প্রধান লক্ষ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধারা যাতে কোনো শহর দখল করে সেখানে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। কারণ এটা করতে পারলেই তারা বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করবে। পাকিস্তানিরা অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলোতে তিন থেকে চার সপ্তাহ চলার মতো গোলাগুলি, রসদপত্র রাখার এবং পশ্চাত্বর্তী প্রতিরক্ষা অবস্থানসমূহে পর্যাপ্ত পরিমাণে রসদ রাখার ব্যবস্থাও করে। অগ্রবর্তী ঘাঁটি রক্ষা দুস্কর হয়ে পড়লে সেখান থেকে যোগাযোগ কেন্দ্র কিংবা গুরুত্বপূর্ণ শহরে পশ্চাদপসরণ করে সে সব স্থান রক্ষার জন্য লড়াই করে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

 কয়েকমাস ধরে পাক সেনাবাহিনী এসব প্রতিরক্ষা ঘাঁটির সকল ব্যবস্থা নিয়ে বেশ তৎপর ছিল। তারা হাজার হাজার কংক্রিটের বাংকার এবং পিল বক্স নির্মাণ করে। ট্যাংক চলাচল ঠেকানোর জন্য সম্ভাব্য পথগুলোতে গভীর নালা কেটে রাখে।