পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
487

রাখতে হবে, তাই একটু দম নিয়ে পিছনে তাকিয়ে লক্ষ্য ঠিক করে নিলাম। শরীর থাকতে থাকতেই আমাকে হাজার গজ দূরে শালবন এলাকায় পৌঁছতে হবে। ক্রলিং শুরু করব, এমন সময় দেখি বাচ্চা ছেলে সালাম, যে পঞ্চাশ গজ ক্রস করে পিছনে হটে গিয়েছিল, হঠাৎ করে আবার দৌড়ে এসে পড়ে থাকা একটা এল-এম-জি নিয়ে ‘জয় বাংলা' বলে হুংকার দিয়ে শত্রুবেষ্টনীর দিকে ধাবিত হলো। ছত্রভংগ হয়ে যাওয়া শত্রুতখন পুনরায় কাউণ্টার এ্যাটাক করার জন্য মাটির দেয়ালের পিছে জমায়েত হচ্ছিল এবং ঘন ঘন ‘আল্লাহ আকবর' ধ্বনি করছিল। “ওরে তোরা আমার মা-বাপ সবাইকে মেরেছিস, আমি ছেড়ে দেব?' বিড় বড় করে পাগলের মত সালাম শত্রুবেষ্টনীর মধ্যে ঢুকে পড়ল। অতি কষ্টে একবার ডাক দিলাম- 'সালাম চলে এস।' কিছুক্ষণ আগে যে আমার জীবন রক্ষা করেছিল সেই সালামকে আর ফিরিয়ে আনতে পারিনি। অথচ বাচ্চা বলে এবং তার সংসারে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি আমি তাকে যুদ্ধে সামিল করিনি। কিন্তু সে পালিয়ে এসে এসেম্বলী এরিয়াতে আমাদের সাথে চুপি চুপি যোগ দেয়। বাংলার শ্যামল গালিচার দুর্বাদলের মাঝে এমনি করে লুকিয়ে আছে হাজারো সালাম।

 সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রটা তখন মহাশ্মশান, মৃতদেহ ছাড়া আর কোন জ্যান্ত মানুষ নেই-বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ হচ্ছে দু'দিক থেকে। শালবনে অবস্থানরত আমার মেশিনগান তখন ঘন ঘন গর্জে উঠেছে। তাই আমি নিজেদের ফায়ার থেকে বাঁচার জন্য ডাইনে অপেক্ষকৃত নিচু ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে এগুতে শুরু করি। এমন সময় কে যেন চিৎকার করে উঠলো-‘এরে আঁই বাঁচতে চাই, তোরা কেউকি আঁর কথা শুনতাছ না। এরে আঁরে লই যা।’ প্রাণটা কেঁদে উঠলো, যদিও করার কিছুই ছিল না। তবুও দাঁত খিঁচিয়ে বললাম, “বেটা চিৎকার করিস না।” তবে তার কাছে যাওয়ার কথা চিন্তা করার আগেই ঐ এলাকা বরাবর একটি আর্টিলারী শেল এসে পড়লো। মাথাটা নিচু করে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকাকালে আঁচ করলাম স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে আমার পাশের মাটি উড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি বাঁ হাত ঠেলে ঠেলে নিজের আহত শরীরটাকে নালার দিকে নিয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে আর কোন চিৎকার শুনিনি। নালার কাছে পৌঁছে সর্বশক্তি নিয়োগ করে খাড়া হয়ে চলতে টলতে টলতে কেমন করে জানি নালাটা পার হয়ে গেলাম আজ বলতে পারব না। মনে হচ্ছে বাঁচতে হবে এই জোরেই বুঝি নালাটা পার হয়েছিলাম। আর পাড়ে ওঠার সাথে সাথেই ধপ করে পড়ে গেলাম। তবুও স্বস্তিবোধ করলাম এই মনে করে যে, শত্রুথেকে অনেক দূরে গেছি এবং অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গায়। সেখানে এসেছি তাতে শত্রুর স্থল আর্ম ফায়ার থেকে প্রায় বেঁচে গেলাম। শরীরটা ক্রমশই ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল, তাই বুঝি সমস্ত জোর দিয়ে খাড়া হয়ে দৌড় দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার আগেই টের ফেলাম ১০/১২ জন শত্রুসেনা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। পিছনে নালার ওপারে আমার এক হতভাগ্য আহত জোয়নকে পেয়ে এক গাল হাসি হেসে ওরা গুলি করল। তারপর কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। তারপর হঠাৎ করে শত্রুর দল থেকে এক বাংগালী আরেক বাংগালীকে বলছে, ‘মকবুল এদিকে আয়, পাওয়া গেছে।' বোধ হয় ঠেলে ঠেলে আসার ফলে কর্দমাক্ত মাটিতে রাস্তা হয়ে গিয়েছিল আমার পালাবার পথ। সাথে হাতের ও ধানক্ষেতের আড়ালে আড়ালে প্রায় ৩০০ গজ আসার পর ধানক্ষেত শেষ হয়ে গেল। এর পরের ২০০ গজ সম্পূর্ণ খোলা ময়দান। ঐদিকে কর্দমাক্ত মাটিতে কোমর পর্যন্ত পানিতে থাকার ফলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, ভীষণ শীত করছিল। ভাবলাম আর বোধ হয় বাঁচা সম্ভব নয়। আমাদের তরফ থেকে কোন জনপ্রাণীরই চিহ্ন নাই। যে মেশিনগান এতক্ষণ ধরে প্রচণ্ড বেগে ফায়ার করছিল সেও চুপ হয়ে গেছে। এফ-ইউ-পি তত্ত্বাবধানে যারা ছিল তারাও চলে গেছে। আমার নিজস্ব কোন ঘড়ি ছিল না। আক্রমণের আগে আমার রকেট লাঞ্চারওয়ালা তার নিজের ঘড়িটা আমাকে দিয়েছিল। ঘড়িটার দিকে একবার তাকালাম। বেলা তখন ৮টা ১০ মিনিট। রোদটা পিঠে লাগছিল। তৃষ্ণায় বড় কাতর হয়ে পড়েছি। কেবলই মনে হচ্ছিল আমার একটা জওয়ান যদি একটা কাভারিং ফায়ার দেয় তবেই আমি রক্ষা পাই। শত্রুতখন পঞ্চাশ গজ দূরে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ক্রমেই আমি তলিয়ে