পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
493

পাঠাবার বন্দোবস্ত করেন। আমিও আর অগ্রসর হতে পারছিলাম না। তাই ডান দিকের বেশ একটা অংশ দখল করে শত্রুর নাকের ডগার উপরে বসে যাই। আমার সাথের বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়েছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ হামিদুর রহমান। এই যুদ্ধে আরও দু'জন জোয়ান তাদের দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন-তাদের একজন হলের হাওলাদর মকবুল হোসেন ও অপরজন সিপাই আব্দুর রহমান, যিনি দুলে পুলিশবাহিনী থেকে আমাদের সাথে যোগ দেন। তুমুল যুদ্ধের পর ব্রিগেড কমাণ্ডার জিয়াউর রহমান সাহেব আমাকে যেখানে ছিলাম সেখানে থাকতে নির্দেশ দেন।

 পাত্রখোলা চা-বাগানের যুদ্ধঃ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, 'এ' 'বি' এবং 'ডি' কোম্পানী যারা পাত্রখোলা চা বাগানের মধ্যে তাদের আধিপত্য করেছিলেন তাদের উপর বেশ কয়েকটা আক্রমণ চলে। কিন্তু আক্রমণের ফলে যথেষ্ট হতাহতের পর শত্রুপিছু হটতে বাধ্য হয়। যেহেতু এই স্থানটা দখল করা ছিল একন্ত প্রয়োজন সেহেতু বড় ধরনের একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। ২৯শে অক্টোবর সকাল ৫টার সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় জাঠ ব্যাটালিয়ন আমাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু সেখানেও আমরা বেশ একটা সুবিধা করতে পারিনি। পর্যায়ক্রমে এক ব্রিগেড ভারতীয় সৈন্য এক ডিভিশন আর্টিলারী নিয়ে আমাদের সাথে অংশ গ্রহণ করে। এভাবে একটানা পাঁচদিন যুদ্ধের পর শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। উল্লেখযোগ্য যে, যুদ্ধে ভারতীয় ব্রিগেড কমাণ্ডার এবং দ্বিতীয় জাঠ ব্যাটালিয়নের কমাণ্ডিং অফিসার আহত হন। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষ যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দেয়।

 ধালাই যুদ্ধের ফলাফলঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনবরত পাঁচদিন যুদ্ধের পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্যে অবশ্য প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাকী সৈন্যদের মধ্যে অনেকে ধরা পড়ে এবং অনেকে পালিয়ে যায়। পরাজয়ের একমাত্র কারণ ছিল শত্রুর লাইন অব কমিউনিকেশন চতুর্দিক থেকে কেটে দেওয়া হয়। তাই সম্মুখসমরে তারা সুবিধা করতে পারেনি। এ যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা পুরোপুরি নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবুও আনুমানিক বলা চরে আমাদের নিহতের চেয়ে আহতই বেশী হয়েছে। অন্যদিকে, শত্রুর নিহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী। ধালাই যুদ্ধে পরাজয়ের পর সিলেটে শুত্রু বাহিনীর ছোটাছুটি অনেক পরিলক্ষিত হয়। কারণ যে ক'টি বিখ্যাত ঘাঁটি ছিল তার মধ্যে ধালাই ছিল অন্যতম। এখান থেকেই প্রায় ৫০ মাইল এলাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হতো।

 সিলেটে যুদ্ধ পরিকল্পনাঃ ১৯৭১ সালের ২০শে নভেম্বর প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট সিলেটে সমস্ত শত্রুর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি দখল করার জন্যে সিলেটের ভিতর দিয়ে ‘এডভান্স টু কণ্ট্যাকট' চালাবার জন্য পরিকল্পনা করা হয়। ২০শে নভেম্বর ঈদের নামাজের পর ভারতের সীমানা অতিক্রম করে বালা গ্রামের কিছু পিছন অবস্থান করি। সমস্ত এলাকা দেখার পরে রাত প্রায় আটটার সময় পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে আমরা কয়েকটি টারগেটের দিকে অগ্রসর হই। উল্লেখযোগ্য যে, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বেশ কয়েকটি টারগেট এখানে ছিল। এদের মধ্যে যেগুলোতে সৈন্যসংখ্যা বেশী ছিল সেগুলোর মধ্যে আটগ্রাম, চারগ্রাম ও বালা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট কতকগুলো শত্রু ছাউনি থাকতে সন্মুখে অগ্রসর হওয়া বেশ দুষ্কর ছিল। কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পরেই চারদিক থেকে ছোট ছোট অস্ত্রের গোলাগুলি আসতে থাকে, ফলে আমাদেরকে কিছুক্ষণের জন্য অবস্থান নিতে হত। পুরা ট্রুপসকে পিছনে রেখে কোম্পানী কমাণ্ডারকে তার দল নিয়ে রেকি করতে হত, তারপর আবার পথ চলতে হতো। এভাবে রাত প্রায় ২টার সময় আমি 'সি' কোম্পানীকে নিয়ে বালায় অবস্থিত টারগেট থেকে প্রায় ১০০ গজ দুরে ডিফেন্স নিই। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ৪৫ গুর্খা বাহিনী ও আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করেছিল। ৪৫গুর্খা বাহিনীর সাথে ছিল আমাদের 'ডি' কোম্পানী। তাদের দায়িত্ব ছিল আটগ্রামের শত্রু ঘাঁটি দখল করা। সব কোম্পানী নিজের নিজের দায়িত্ব পালন করার জন্য সুবিধামত টারগেটের নিকটবর্তী কোন জায়গায় হাইড-আউট করেছিল। শত্রু বাঙ্কারগুলো ইতস্তত বিক্ষিত থাকাতে আমাদের নড়াচড়া একটু সাবধানেই করতে হতো। আমাদের এইচ-আওয়ার ছিল সকাল ৬টা। সুতরাং এইচ- আওয়ারের পাঁচ মিনিট আগে গোলন্দাজ বাহিনীকে ডাকা হয়-যাকে বলা হয় প্রি-আওয়ার গোলাবর্ষণ। ৫