পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
494

মিনিট নর্মাল ফায়ার এর পর গোলন্দাজ চুপ হয়ে যায়। তার সাথে বালা, চারগ্রাম ও আটগ্রামের উপর বঙ্গশার্দুল ও গুর্খারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। অর্ধ ঘণ্টার ও বেশী সময় তুমুল গোলগুলির পর তিনটি শত্রু ঘাঁটিই আমাদের করায়ত্ত হয়। এদের মধ্যে শত্রুর সরচেয়ে বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয় আটগ্রামে। এটা শত্রুর ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার এবং দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিল। এখানে বেশকিছু এ্যামুনিশন ডাম্প ও ছিল। অবশ্য শত্রু সহজেই আত্মসমর্পণ কেরেনি। যথেষ্ট হতাহতের পর কিছু আত্মসমর্পণ করে এবং কিছু এদিক ওদিক পালিয়ে যায়। আটগ্রামের শত্রুর হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০জন, এদের মধ্যে ৪জন অফিসার ছিলেন। যথেষ্ট গোলবারুদ আমাদের হস্তগত হয়। এখানে শত্রুবেশকিছু গোলাবারুদ ফেলে যায় এবং হতাহতের সংখ্যা ছিল শত্রু পক্ষে ১০-১৫জন এবং অস্ত্রসংবরণ করে ৭জন। চারগ্রামে অবশ্য শত্রু যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আমাদের আক্রমণের আশংকা বুঝতে পেরে তারা পশ্চাদপসরণ করে এবং কোনরকম বাধা ছাড়াই আমরা চারগ্রাম দখর করি। এখানে অবশ্য হতাহতের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

 বালা দখল করার পর আমরা করিমগঞ্জের দিকে রওনা হই। করিমগঞ্জ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট দখল করতে সমর্থ হয়। অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) এ. জে. এম আমিনুল হক।

 এরপর করিমগঞ্জ থেকে আমরা বৈয়ামপুর রওনা হই এবং বৈয়ামপুর আমাদের দখল নেয়ার পরিকল্পনা কির। কিন্তু বৈয়ামপুর যাবার পথে পাকসেনা আমাদের উপর এ্যামবুশ করে। ফলে আমাদের দু'জন যোদ্ধা শহীদ হন, দু'জন নিখোঁজ হন এবং ৬জন গুরুতরভাবে আহত হন। ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট লিয়াকত গুরুতররুপে আহত হন। তিনি আহত হবার পর আমি সি কোম্পানী ক্যাপ্টেন নূরকে হস্তান্তর করে “এ” কোম্পানী দায়িত্ব গ্রহণ করি। বৈয়ামপুর ছিল করিমগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫/৪০ মাইল দুরে। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মাহবুব আর্টিলারী শেলিং করেন। পাকসেনারাও আর্টিলারী শেলিং করা থেকে বিরত ছিল না। আর্টিলারী শেলিং বিনিময়ের এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন মাহবুব হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন। শেলিং এর টুকরা তার শরীরে আঘাত করে। অতঃপর ক্যাপ্টেন মাহবুবকে সরিয়ে নেয়া হয়। কিছুক্ষণ পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং শহীদ হন। তাঁর সিগনালারও শহীদ হন এবং রানার আহত হন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই তিনজন মুক্তিসেনার নাম অবিস্বরণীয় থাকবে যুগ যুগ ধরে, এই আশাই আমি রাখি। পরদিন সকালে ৩১তম রেজিমেণ্ট আমাদেরকে আক্রমণ করে। কিন্তু এ আক্রমণে তারা ব্যর্থ হয় এবং তিনজন অফিসার ও তিনজন সুবেদার নিহত হয়। ১২ জন পাঞ্জাবী আমাদের হাতে বন্দী হয়।

 এর পরদিন সকালে আমরা বৈয়ামপুর থেকে শহীদপুরের দিকে যাত্রা করি এবং এখানেও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। আমাদের নয়জন হতাহত হন। তারপর আমরা কচুয়া পর্যন্ত অগ্রসর হই এবং ডিফেন্স নিই। ই-পি- আর বাহিনী ইতিপুর্বেই কানাইঘাট দখল করেছিল। আমরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই।

 রণকৌশলের দিক থেকে বিচার করলে কোন দূরদর্শী সেনাবাহিনীই তার শত্রুকে পেছনে ফেলে রাখতে চায় না, কারণ পিছনের আক্রমণকে প্রতিহত করা অনেক সময় বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। সে জন্যে আমরা শত্রু ঘাঁটির মধ্য দিয়ে এডভান্স টু কণ্টাকট শুরু করি। কানাইঘাট থেকে বিকেল ৫টার সময় আমরা সিলেট এম. সি. কলেজ অভিমুখে যাত্রা করি। কারণ আমরা জানতাম এম. সি. কলেজকে পাকিস্তানী বাহিনী বিরাট একটা দুর্গে পরিণত করেছিল। সেই দুর্গকে অবরোধ করে দখল করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। পরদিন বিকেল ৫টার সময় আমরা কেওয়াচরা চা বাগানে ডিফেন্স স্থাপন করি। রাত্রিবেলা পেট্রোল পার্টি পাঠানো হয়েছিল শত্রুর গতিবিধির খোঁজখবর নেয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার পেট্রোল পার্টি শত্রুর এ্যামবুশে পড়ে এবং একজন নিখোঁজ হয়। শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর পাওয়ার পর সকালবেলা আমি আমার কোম্পানীকে নিয়ে সন্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলাম। কিন্তু শত্রুদ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কতক্ষণ ডিফেন্স থাকি। এই দুই ঘণ্টার মধ্যেই অন্যান্য