পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
27

 এ ব্যাপারে পাকিস্তানীদের অর্থের কোনো অভাব ছিল না। শরণার্থী সাহায্য ও পুনর্বাসন কর্মসূচীর নাম করে ইয়াহিয়া খান মোটা অংকের অর্থ যোগাড় করেছিলেন। আসলে ভারত থেকে তখনো কোনো শরণার্থী ফিরে আসেনি। অল্প সংখ্যাক যারা এসেছিলো তারাও সেনাবহিনীর তথ্যকথিত অভ্যর্থনা কেন্দ্র দিয়ে ফিরে আসেনি। তারা যে পথে ভারত গিয়েছিলো সেই গোপন পথেই ফিরেছে। মাঝ থেকে শরণার্থীদের জন্য পাওয়া পুরো টাকাটাই প্রতিরক্ষা বাজেটের অংশ হিসেবে নিয়াজীর হাতে তুলে দেয় হয়। বেলুনিয়ার একটি মাত্র ট্যাংকবিরোধী নালা তৈরী করতে পাকিস্তানীরা প্রায় ২০ লাখ টাকা করচ করে।

 অপরপক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনী পশ্চিম ফ্রণ্টে আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা এবং পূর্ব ফ্রণ্টে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অবশ্য পশ্চিম ফ্রণ্টে ভারতীয় সেনাবাহিনী অনুকুল পরিস্থিতির সুযোগে কোন কোন সেক্টরে পুরোপুরি আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যতোদুর সম্ভব অগ্রসর হওয়ারও পরিকল্পনা করে।

 ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো ছিল নিম্নরুপঃ

 (1) যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে (সর্বাধিক তিন সপ্তাহের ভেতরে) মুক্তিফৌজের সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীন করা।

 (2) চীন দেশের দিক থেকে সম্ভাব্য হামলার বিরুদ্ধে ভারতের উত্তর সীমান্ত রক্ষা।

 (3) আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সংহতি রক্ষা এবং

 (4) নাগাল্যাণ্ড, মনিপুর এবং মিজোরাম এলাকায় বিদ্রোহাত্মক তৎপরতার দমন করা।

 এই কাজগুলো মোটই সহজসাধ্য ছিলো না। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি দ্রুত সৈন্য চলাচলের জন্য অনুপযুক্ত। পুরো দেশ জুড়ে রয়েছে নদীনালা খাল বিল। এগুলোর জন্য যে কোনো বাহিনীর অভিযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য।

 এই সব প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক অবস্থানের মূল্যায়ন করে বাংলাদেশকে মোটামুটি চারটি পৃথক সেক্টরে ভাগ করা হয়। এই সব সেক্টরে ভারত এবং পাকিস্তানীদের অবস্থান ছিলো নিম্নরূপঃ

 ১। উত্তর পশ্চিম সেক্টর: যমুনার পশ্চিম এবং পদ্মার উত্তরের অঞ্চল এই এলাকার অন্তর্ভুক্ত। সেক্টরের আওতাধীন জেলাগুলো ছিলো রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী এবং পাবনা। মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহের অধীনে পাকিস্তানের ১৬ ডিভিশন এই সেক্টরের হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেছিলো নাটোরে। এই সেক্টরে সর্বত্র এবং বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, হিলি ও রংপুরে দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিলো।

 পাকিস্তানী ১৬ ডিভিশনের মোকাবিলায় ভারত তার ৩৩ কোরের (লে. জেনারেল থাপা) অধীনে দুটি মাউণ্টেন ডিভিশনকে নিয়োজিত করে। এই ডিভিশনগুলোর সহায়ক হিসেবে নিয়োজিত ছিলো ডিবিশনাল গোলন্দাজ বাহিনী, একটি মাঝারি ট্যাংক রেজিমেণ্ট এবং হালকা উভয়চর ট্যাংকের (পিটি-৭৬) আর একটি রেজিমেণ্ট। ভারতীয় ডিভিশনগুলো ছিলো উত্তরে কুচবিহার জেলায় ৬ মাউণ্টেন ডিভিশন, বালুরঘাট এলাকায় ২০ মাউণ্টেন ডিভিশন এবং শিলিগুড়ি এলাকায় ৭১ ব্রিগেড। বাংলাদেশে অভিযানের দায়িত্ব পালন ছাড়াও ৩৩ কোরকে সিকিম ও ভুটানের মধ্যে দিয়ে সম্ভাব্য চীনা আগ্রাসন প্রতিহত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো।

 ২। পশ্চিম সেক্টর: পদ্মার দক্ষিণ এবং পশ্চিম এলাকা নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের জেলাগুলো হচ্ছে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল এবং পটুয়াখালি। এই সেক্টরের মেজর জেনারেল এম এইচ আনসারীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯ পদাতিক ডিভিশন মোতায়ন করা হয়। এই সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল যশোরে।