পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
497

৩" মর্টার, রকেট লাঞ্চার ও মেশিনগান ব্যবহার করি। রাত্রি ভোর হওয়ার আগেই পুনরায় ব্রক্ষ্মপুত্র নদ পার হয়ে ২ মাইল ভিতরে অপর এক চরে আমরা সকলে আত্মগোপন করি৷

 ১লা আগস্ট পাকবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার সারাদিন আমাদের খুঁজে বেড়ায় কিন্তু আমরা খুব সতর্ক থাকায় আমাদের সন্ধান পায়নি। তারপর আমরা দেওয়ানগঞ্জ অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হই।

 ২রা আগস্ট সন্ধ্যার সময় ৬টা নৌকাযোগে দেওয়ানগঞ্জে বাজার ও চিনি কলের দিকে রওনা হই। পথে বাহাদুরবাদ ঘাট ও দেওয়ানগঞ্জের মাঝখানে একটি রেলওয়ে ব্রীজ লেঃ নুরুন্নবী উড়িয়ে দেন, যাতে পাকবাহিনী বাহাদুরবাদ সহজে আসতে না পারে। গভীর রাতে দেওয়ানগঞ্জের অনতিদুরে গিয়ে আমরা ‘এ’ কোম্পানী নিয়ে দেওয়ানগঞ্জের সুগার মিলে পাক ডিফেন্সের দিকে অগ্রসর হই। লেঃ নুরুন্নবী দেওয়ানগঞ্জ বাজারের দিকে চলে যান। রাত্রি পৌনে চারটায় একই সময়ে নিজ নিজ টারগেটের উপর আক্রমণ চালাই। ৪৫ মিনিট এই হামলা চলে। আমাদের আক্রমণে দেওয়ানগঞ্জ সুগার মিল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বহু পাকসেনা হতাহত হয়। দেওয়ানগঞ্জ বাজারে রাজাকার প্রশিক্ষন ক্যাম্প ও রেলওয়ে স্টেশনের বহু ক্ষতি সাধিত হয়। সেই সময় সেখান থেকে নৌকাযোগে আমরা অপর চরে আত্মগোপন করি। আমাদের এই দুটি আক্রমণে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণ ও স্থানীয় এফ-এফ কমাণ্ডার আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করেন।

 ২রা আগস্ট আমরা তেলঢালার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ৫ই আগস্ট আমরা তেলঢালায় এসে পৌঁছি।

 ৮ই আগস্ট আমার 'এ' কোম্পানী নিয়ে রৌমারী থানাকে আমাদের দখলে রাখার উদ্দেশ্যে কীর্তিমারী চরে ডিফেন্স নিই, পরে কোদালকাটির চর, পীরের চর ও চর সাজাইতে আমার বিভিন্ন প্লাটুনকে ডিফেন্সে লাগাই। উক্ত চরে ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিফেন্সে থাকি। এই পাঁচ সপ্তাহে পাকবাহিনী কয়েকবার নদীপথে হামলা চালায়, কিন্তু প্রতিবারই আমাদের হাতে আক্রান্ত হয়ে পিছনে হটে যায়। এখানে পাক বাহিনীর অনেক সৈন্য আহত হয়। আমাদের পক্ষে পনের জন জোয়ান আহত হয়। এই পাঁচ সপ্তাহে আমরা চীলমারী থানার কয়েকটি গেরিলা অপারেশন করি।

 ১৬ই সেপ্টেম্বর প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লেঃ কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে আমাদের নিকট থেকে দায়িত্ব ভার গ্রহন করেন। আমি আমার কোম্পানী নিয়ে তেলঢালায় ফিরে আসি। ৪ঠা অক্টোবর পর্যন্ত তেলঢালার আশেপাশে কয়েকটি ছোট ছোট অপারেশন করি।

 ৬ই অক্টোবর ‘জেড' ফোর্স তেলঢালা ছেড়ে দিয়ে তৎকালীন ৪ ও ৫ সেক্টরের দিকে সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্ণেল মীর শওকত আলী ছাতক আক্রমণের জন্য আমাদের কোম্পানী কমাণ্ডারদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। ১০ তারিখ সকালে উক্ত এলাকা রেকি করা হয়। ১১ তারিখ রাত্রে ছাতকের সন্নিকটে মহড়াটিলা নামক জায়গা দখল করে ফেলি। আমার বাম পার্শ্বে মেজর আকবর তার কোম্পানী নিয়ে জয়নগর টিলাতে ডিফেন্স নেন। ১২ তারিখ সকালে পাক বাহিনী আমাদের গতিবিধি দেখতে পায় এবং সেখানে পাক বাহিনীর সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয়। আমরা সেখানে সর্বাধুনিক হাতিয়ার ব্যবহার করি। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ২ জন অফিসার নিহত হয় ও একজন কর্নেল আহত হয়। তাছাড়া বহু পাকসেনা হতাহত হয়। ঐ দিন রাত্রিতে আমরা সেখানেই থেকে যাই।

 ১৩ তারিখ রাত্রি ৯ ঘটিকার সময় সুরমা নদীর পাড়ে নড়াই গ্রাম ও সিমেণ্ট কারখানার উপর আক্রমণ করি। আমাদের আক্রমণে পাকবাহিনী পিছু হটে যায়। আমরা নড়াই গ্রাম ও সিমেণ্ট কারখানা দখল করে ফেলি এবং রাত্রেই সেখানে ডিফেন্স করি।

 ১৪ তারিখ সকালে পাক বাহিনীর একটি লঞ্চ ছাতক আসার পথে রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে সেটিকে ডুবিয়ে দিই। সেখানে ৯ জন খান সেনা নিহত হয় এবং রাজাকার ইসাহাকসহ ৯ জন আমাদের হাতে ধরা পড়ে। এখানে ১৪ টি রাইফেল উদ্ধার করি। সারা দিন তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ চলে। আমাদের ৩ জন আহত হয়।