পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
499

 ১৩ই জুলাই মেজর(বর্তমানে লেঃ কঃ) মঈনুল হোসেন চৌধুরী আমার ব্যাটালিয়নের কমাণ্ডিং অফিসার নিযুক্ত হন এবং আমার নিকট থেকে ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব গ্রহন করেন। তাছাড়া আরও কয়েকজন অফিসারকে ব্যাটালিয়ন অফিসার নিযুক্ত করেন- তারা হলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান, লেফটেন্যাণ্ট (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আব্দুল মান্নান, লেফটেন্যাণ্ট (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এবং আমাদের ব্যাটালিয়ন এ যোগদান করেন।

 কামালপুর যুদ্ধঃ মোটামুটি ট্রেনিং এর পর প্রথম অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। ময়মনসিংহ জেলার কামালপুরে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিকে আঘাত করার পরিকল্পনা 'আমরা প্রথম নিই। কামালপুর এলাকার চতুর্দিক দিয়ে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে আমরা প্রথম 'রেকি' করি।

 ২৮শে জুলাই গভীর রাতে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মোমতাজ, লেফটেন্যাণ্ট মান্নান, নায়েক সুবেদার আবদুলহাইসহ আরও দু'জন সৈন্য ‘রেকী' করতে করতে কামালপুর শত্রুঘাঁটির ভিতর ঢুকে একটা বাঙ্কার এর মধ্যে উঁকি মারে। এমন সময় পাকিস্তানী দু'জন সৈন্য অন্যদিক থেকে বাঙ্কারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন তাদের দেখে ফেলেন এবং তৎক্ষনাৎ তাদেরকে “হ্যাণ্ডস আপ” করতে বলেন। দু'জনের একজন “হ্যাণ্ডস আপ” করে। অপরজন না করাতে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন লাফ দিয়ে উক্ত পাকিস্তানী সৈন্যর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং দু'জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। কিছুক্ষন ধস্তাধস্তির পর যখন তারা বুঝতে পারে যে, তারা মুক্তিযোদ্ধার দ্বারা ঘেরাও তখন তারা পালানোর চেষ্টা করলে সুবেদার হাই তাদের উদ্দেশ করে গুলি ছোড়েন এবং হত্যা করে রাইফেল দুটি নিয়ে নেন। পরে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনসহ সবাই ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। এ ঘটনায় আমাদের সৈন্যদের মনোবল অত্যন্ত বেড়ে যায়। নায়েক সুবেদার আবদুল হাইকে এজন্য বাংলাদেশ সরকার “বীর প্রতীক” উপাধীতে ভূষিত করেন।

 ৩১শে জুলাই ভোর সাড়ে তিনটার সময় দুই কোম্পানী সৈন্য ('বি' কোম্পানী, যার কমাণ্ডার ছিলাম আমি নিজে এবং ‘ড’ কোম্পানীল যার কমাণ্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মোমতাজ) নিয়ে কামালপুর বর্ডার আউট পোস্ট আক্রমণ করি। আমরা একটা ফিল্ড ব্যাটারীর সাহায্য নিই। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ‘এ কোম্পানীকে পাঠানো হয় উঠানীপাড়াতে (কামাল পুর থেকে ২ মাইল দক্ষিণে)। 'এ' কোম্পানীকে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল তারা 'কাট অফ' পার্টিতে যেন যোগ দিতে পারে। এফ-ইউ-পি' তে যোগ দিতে পারে। এফ –ইউপি তে পৌঁছার পরই আর্টিলারী ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু এফ-ইউ-পি তে পৌঁছার পুর্বেই আমাদের পক্ষ থেকে আর্টিলারী গোলাগুলি শুরু হওয়ায় আমাদের সৈন্যরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এ সময় শত্রু পক্ষও আর্টিলারী ও ভারী মর্টারের সাহায্যে গোলাগুলি শুরু করে। তা সত্ত্বেও আমি এবং সালাহউদ্দিন আমাদের কোম্পানীদ্বয়কে একত্রিত করে শত্রুদের আক্রমন করি এবং সম্মুখ দিকে অগ্রসর হই। দু'দিকেই আর্টিলারী ব্যবহার হওয়া সত্ত্বেও আমরা 'জয় বাংলা' ধ্বনি দিতে দিতে শত্রুর দিকে অগ্রসর হই। আমরা কাঁটাতার এবং মাইনফিল্ড অতিক্রম করে অগ্রসর হই এবং গোলাগুলি চলাকালীন সময়ের মধ্যেই শত্রুপক্ষের অর্ধেক জায়গা দখল করে নেই। ফলে শত্রুরা পিছনের দিকে হটে যায় এবং তাদের পূর্ব স্থানে আর্টিলারী ও মর্টারের গোলাবর্ষন করতে থাকে। এ সময় ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন যিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে ‘ডি’ কোম্পানীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, শত্রুর গুলিতে শহীদ হন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তাঁর সৈনিকদের উৎসাহ ও সাহস দিতে থাকেন এবং বার বার শত্রুপক্ষকে নির্মূল করার আকুল আহবান জানান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর মত দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন সৎসাহসী বীর ও আত্মত্যাগী যোদ্ধার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। যে কোন দেশের যে কোন জাতির গর্ববোধ করতে পারে তাঁর মত বীর যোদ্ধার বীরত্বের জন্য। একটু পরেই আমি নিজেও শত্রুর মর্টারের গুলির আঘাতে আহত হই এবং আমাকে পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার শরীরের পাঁচ জায়গায় মর্টারের গুলির টুকরো বিদ্ধ হয়। উভয় কোম্পানীতে কোন অফিসার ও অফিসার কমাণ্ডিং না থাকায় এবং ইতিমধ্যে যথেষ্ট সৈন্য হতাহত হওয়ায় আমাদের সৈন্যদের মনোবল