পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
519

 আমরা চালনা বন্দরেও ছোট ছোট দলে ভাল হয়ে অপারেশন চালাতাম। ছোট নৌকা আমাদের কাছে যথেষ্ট ছিল। ছোট নৌকায় যেমন দ্রুত চলাচল করা যেত তেমনি নিরাপত্তা ও ছিল। আমরা যে জায়গায় থাকতাম, সেখানথেকে অনেকদুরে গিয়ে অপারেশন করে আসতাম। ফলে আমাদের অবস্থান পাকসেনাদের দৃষ্টিগোচর হতো না। একদিন দিনের বেলা মাঝি সেজে এক জাহাজে মাইন লাগিয়ে চলে আসি। এক ঘণ্টা পর জাহাজখানা ডুবে যায়। একদিন সংবাদ পেলাম যে দুইখানা আমেরিকান জাহাজ পোর্টের মধ্যে নোংগর করেছে, তার মধ্যে একখানা বোমা ও একখানা অস্ত্র গোলাবারুদ রয়েছে। এ কথা শোনার পর ভীষন আলোড়নের সৃষ্টি হলো। যেমন করে হোক জাহাজ দুইটি ডুবাইতেই হবে। ঐ রাত্রে আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। প্রবল বেগে বাতাস বাইতেছিল। নদীতে খুব বড় বড় ঢেউ উঠছিল। এই সময় আমাদের লক্ষ্যর চন্য উপযুক্ত মনে করে সন্ধ্যার পরপরই ২৪ জন ছেলেসহ আমি নিজে তৈরী হলাম। রহমত উল্লা, আরেফিনও নদীর ধারে পজিশন নেওয়ার জন্য প্রস্তত্তত হলেন।

 বনের মধ্য থেকে বের হয়ে আমাদের ছোট নৌকা বিলের মধ্য দিয়ে পোটের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। লক্ষ্যের নিকটবর্তী হয়ে আমরা কিছু সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম। এর মধ্যে স্থল বাহিনীকে বিভিন্ন স্থানে পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণের জন্য তৈরী থাকতে বললাম। এদিকে পোর্ট থেকে সার্চলাইট চারদিকে নজর রাখা হচ্ছে কিছু সময় অপেক্ষা করার পর এক সুযোগ নেমে পড়ি চার ভাগে ভাগ হয়ে ৪টা জাহাজ ডুবানোর জন্য। আমার জাহাজটা ছিল একটু দুরে। ঐ জাহাজটাতে ছিল অনেক গোলাবারুদ তাতে কড়া পাহারা ছিল। কোন ছেলে ঐ জাহাজটাতে যেতে সাহস পেল না। আমি ৬জন সাহসী ছেলে সহ নিজে রওয়ানা দিলাম। এদিকে বাকী তিনটি জাহাজে ছেলেরা প্রায় পৌছে গেছে। আমি জাহাজের নিকট পোঁছা মাত্রই আমার উপর সার্চ লাইট এসে পড়ে। পাহারারত সাস্ত্রী আমাকে দেখতে পেয়ে আমার দিকে গুলি চালায়। গুলিটি আমার বাম হাতের কুনুইয়ে লেগে যায়। তখন আমি আমার কোমর থেকে একটা গ্রেনেড বের করে দাত দিয়ে পিনটা খুলে ফেলি। গুলি করার সংগে সংগে আমি পানিতে ডুব দিয়েছিলাম। ফলে বাকী গুলি আমার আর লাগেনি। তখন উপর থেকে আমাদের উপর ডেপথ চার্জ করা হয়। এবং পাহারাদার চিৎকার করে বলতে থাকে ‘ক্যাপ্টেন সাহাব, ক্যাপ্টেন সাহাব, মুক্তি আ রাহা হাঁয়’। আমি আমার গ্রেনেড জাহাজের উপর ছুড়ে মারি। সংগে সংগে জাহাজে আগুন ধরে যায়। এদিকে সার্চ লাইট লক্ষ্য করে আমার দল গুলি চালায়, ফলে সার্চলাইট বন্ধ হয়ে যায় আমার দুটি ছেলে ডেপথ চার্জের ফলে ভীষণভাবে আহত হয়। আমি তখন বাকী ৪জনসহ ডুব দিয়ে জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে দিই। তখন আমার মৃত্যুভয় চলে গেছে। মরার আগে আমি জাহাজকে ডুবিয়ে মরবো। গ্রেনেড মারার ফলে জাহাজে আগুন ধরে যাওয়ায় আমাদের উপর আর আক্রমন হয়নি। তদুপরি আমাদের স্থলবাহিনী ওপর থেকে পাল্টা আক্রমন চালাচ্ছিল। ভীষণ গোলাগুলি চলতে থাকে। পোর্টে ব্ল্যাক আউট ঘোষনা করে আমাদেরকে ধরার জন্য স্পীডবোট নিয়ে নদীর মধ্যে খোজাখুজি শুরু করে দেয় পাকসেনারা। আমি তখনও জাহাজের গা ধরে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে জাহাজের নিচে অপেক্ষা করছিলাম। বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে পারলাম না। কেননা, আমার নির্দিষ্ট সময় পার হয়েগেলে মাইন ফেটে যাবে। আমার মাইন এর সময় ছিল ৪৫মিনিট। এসময়ের মধ্যে ৫০০ গজ দূরে না যেতে পারলে মাইন এর শব্দে বুক ফেটে মারা যাবো। আর দেরী করা নিরাপদ নয় দেখে বাধ্য হয়ে ওখান থেকে আহত ছেলে দুটোকে ংগে করে রওয়ানা দিতে গিয়ে দেখি তারা তখনও মাইন লাগাতে পারেনি। ফিরে চেয়ে দেখি আমার সঙ্গী বাকি ৪জন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আহত ছেলে দুটির অবস্থা এতবেশি খারাপ হয়ে গেছিল যে ডুব দিয়ে জাহাজের গায়ে মাইন লাগানোর মত ক্ষমতা ছিল না। তাড়াতাড়ি মাইন দুটি নিয়ে জাহাজের গায়ে লাগিয়ে দিই। এবং দুইজনকে আমার সংগে আমার বাহুতে এক হাত রেখে সাতার দিতে বলি। তারা এত দুর্বল ছিল যে, সাতারের ক্ষমতা তাদের রহিত হয়ে গিয়েছিল। আমারও বাম বাহু থেকে রক্ত বার হচ্ছিল। কিছুদূর সাতার কাটার পর আমিও ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ি। এমন সময় আমার দিকে একখানা স্পীডবোট আসতে দেখে ৩ জন মিলে ডুব দিই। স্রোত এত বেশী ছিল যে, ডুব দেওয়ার পর আমরা দলছাড়া হয়ে পড়ি। তখন ছেলে দুটি যে কোন দিকে চলে গেল দেখতে পেলাম না। স্পীডবোট উপর দিয়ে চলে গেলে আমি পানির উপর উঠে আর ওদের সাথী