পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
520

হতে পারলাম না। তখন একই কুলে গিয়ে উঠি। তখনও উভয় পক্ষে ভীষন গোলাগুলি চলছে। খুব বেশী রক্ত ঝরাতে আমিও প্রায় অবশ হয়ে পড়ি। ছেলে দুটোকে রক্ষা করতে না পেরে মনের অজান্তে চোখ দিয়া অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বেশ কিছু সময় বিশ্রাম নেয়ার পর কোমরের গামছা ছিড়ে হাতে বাধন দিই, তাতে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে যায়। ছেলে দুটোকে রক্ষা করতে না পেরে ভারাক্রান্ত মনে ওয়াপদা বাধ পার হয়ে আমার নির্দিষ্ট জায়াগার দিকে এগোতে থাকি। এমন সময় নদীর মধ্যে মাইন ফাটা আরম্ভ হয়ে গেছে। এস ও এস শব্দে সারা পোর্ট ধ্বনিত হয়ে উঠেছে।

 শিবিরে ফেরার পর আমরা বেশ কয়েক দিনের জণ্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। তখন বনের পার্শ্ববর্তী নদীমুখ গানবোট দিয়ে পাকবাহিনী পাহারা দিতে আরম্ভ করেছিল। বেশ কয়েকটি গানের আমাদের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে। আমাদের ঐ সময় গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। এ সময় পাকিস্তানীরা ঘোষনা করে যে, মংলা বন্দরে কোন জাহাজ ৭২ মাইলের মধ্যে আসতে পারবে না। যে জাহাজগুলি ঐ সময় ছিল সেগুলিকেও সমুদ্রের মধ্যে চলে যেতে নির্দেশ দেয় পাক সরকার। তখন বন্দর খালি হয়ে যায়। ঐ সময় গানবোট ও প্রয়োজনীয় জাহাজ ছাড়া আর কোন জাহাজ বন্দরে ছিল না।

 আমাদের তৎপরতায় মংলা বন্দরে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আমরাও প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। তাছাড়া আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়াতে অপারেশন একরূপ বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায়ও আমি পাক জাহাজ অর্থাৎ গানবোটের উপর আক্রমন চালানোর চেষ্টা করি, কিন্তু গোলাবারুদ কম থাকায় সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে আমরা কলাগাছে মাইন বেধে জোয়ারের সংগে ছেড়ে দিতাম। কিছু সময় পর জোয়ারের স্রোতের সংগে ভেসে গিয়ে মাইন নদীর মধ্যে ফেটে যেতো। এতে পাকসেনারা ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো। আমরা কচুরিপানা একত্র করে তাতে ডিলো পেন্সিল সেট করে জোয়ারের সংগে ভাসিয়ে দিতাম। কিছু সময় পর নদীর মধ্যে বন্দরের কাছে গিয়ে তাতে আগুন ধরে যেতো, এতে সারা নদীতেই আগুন ধরে যেত। এইভাবে আমরা পাকসেনাদের মনে প্যানিক সৃষ্টি করি।

 আমাদের তৎপরতায় পাকসেনারা অতিষ্ট হয়ে আমাদের জোর অনুসন্ধান চালাতে আরম্ভ করে। হেলিকপ্টারযোগে বনের উপর দিয়ে ভয়ে ভয়ে আমাদের সন্ধান করতে থাকে। পরে আমাদের গোপন শিবির জানতে পেয়ে আমাদের উপর একদিন হঠাৎ বিমান আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের বেশ কয়েকটি ছেলে আহত হয়। আমরা শিবির পরিবর্তন করে আরও গভীর বনের মধ্যে চলে যাই এবং নতুন শিবির স্থাপন করি। গোলাবারুদ শেষ হয়ে আসায় আমি এসময় রহমতউল্লাহ সাহেবকে শিবিরে রেখে আবার মেজর জলিলের নিকট চলে যাই গোলাবারুদ সংগ্রহ করার জন্য। আমাকে তখন কলিকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমি কলিকাতা চলে আসি। ৮নংথিয়েটার রোডে ওসমানী সাহেবের সঙ্গে আমাকে দেখা করিয়ে দেওয়া হয়। তখন ওসমানী সাহেব আমাকে আমাদের চৌধুরী সাহেব ও নজুরুলের সংগে মিলিয়ে দেন এবং আমাদেরকে শিবিরে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন। আমি কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর কল্যানী শিবিরে চলে আসি। ওখান থেকে আবার আমাদের পলাশী শিবিরে প্রেরন করা হয়। পলাশীতে এসে দেখতে পেলাম শিবিরে আমার জন্য ২০০ ছেলে অপেক্ষা করছে ফুলছড়িঘাট অপারেশন করার জন্য। আরও শুনতে পেলাম ফুলছড়িঘাটে আমার বন্ধু রকিব অপারেশন করতে গিয়ে মারা পড়েছেন। শুনতে পেলাম চলিত জাহাজে মাইন লাগাতে গিয়ে জাহাজের নিচে পড়ে তিনি মারা যান। রকিব আমার বিশিষ্ট বন্ধু ছিল। তার মৃত্যুতে আমার মনে ভীষণ আঘাত লাগলো। বেশ কয়েকদিন পর আবার আমি তৈরী হতে থাকি। এমন সময় এক সন্ধ্যায় শুনতে পেলাম পাক সরকার হিন্দুস্থানের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে দিয়েছে।

স্বাঃ বদিউল আলম
১১-৬-৭৯