পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ১৬ই ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেখানে তৎকালীন প্রসিডেণ্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব মনসুর আলী, খন্দকার মুশতাক সবাই উপস্থিত ছিলেন। আমাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে যাবার জন্য বলা হয়। আমি ভারতীয় সামরিক বাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করি। আমাকে দমদম বিমানবন্দরে যেতে বলা হয়। আমি কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে গেলাম। সেখানে জেনারেল আরোরা, জেনারেল জেকব এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অনেক উচ্চপদস্থ অফিসার ছিল। আমরা বাংলাদেশের পথে প্রথমে আগরতলাতে আসলাম। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে রওনা হলাম।

 ঢাকা বিমানবন্দরে রানওয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রাস্তাঘাটে খুব বেশি লোকজন ছিল না। এ অবস্থা আমরা বিমানে বসে লক্ষ করছিলাম। বিমানবন্দরে খুব একটা ভিড় ছিল না। আমরা বিমান থেকে অবতরন করলাম। জেনারেল নিয়াজী আমাদেরকে সংবর্ধণা জানালেন।

 আমরা বিমানবন্দর থেকে সোজা রেসকোর্সের মাঠে গেলাম। সেখানেও আস্তে আস্তে লোকের ভিড় হচ্ছিল। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু যেখান থেকে ভাষন দিয়েছিলেন সেখানে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। জনগন আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। তারা জেনারেল আরোরাকে কাঁধের উপর উঠিয়ে নেয় এবং বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠে। জেনারেল নিয়াজীকে খুব বিমর্ষ দেখা হচ্ছিল।

 ভারতীয় সরকার এবং জনগন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অভূতপূর্ব সাহায্য এবং সহযোগিতা করেছেন। ভারতকে সবসময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করতে হয়েছে। বিশ্ব জনমতের প্রতিক্রিয়া কি, সেটাও লক্ষ্য রাখতে হয়েছে। তাদেরকে অনেক অনেক ভেবেচিন্তে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সাহায্য করতে হয়েছে।

 আমি বলতে চাই তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে কেনা কিছু করেনি। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষন করেছে এবং ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে। রাজনৈতিক কুটনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সবকিছু করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্নদেশ সফর করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে উপমহাদেশের ঘটনাবলী অবহিত করেছিলেন। আমার মনে হয় ভারত যুদ্ধের জন্য প্রথমে প্রস্তুত ছিলনা। কিন্তু বিভিন্ন দেশ সফর করার পর হয়ত ভারত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

 ভারত প্রথমে আমাদেরকে স্বীকৃতিও দেয়নি। কারণ, যদি ভারত আমাদের প্রথমে স্বীকৃতি দিত তাহলে হয়ত বিশ্বজনমত যুদ্ধের জন্য ভারতকে দোষারোপ করত। অবশ্য ভারতীয় সেনাবহিনীর কিছু কিছু অফিসারের কার্যকলাপ জনসাধারনের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধে ভারতের জয়ের তিনটি প্রধান কারণ ছিলঃ ১। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যাতায়াত ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল। সেনাবাহিনীর চলাচলে কোন নিরাপত্তা ছিল না। তাদেরকে সব জায়গায় প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ২। ভারতীয় বিমান বাহিনীর অভূতপূর্ব সাফল্য যুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল। বিমান বহিনীর আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব জায়গা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের সাহায্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমস্ত গোপনীয় তথ্য জেনে নেয়।

স্বাক্ষরঃ আবদুল করিম খন্দকার
১৮-১০-১৯৭৩