পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
542

পরিকল্পনা পাকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়াজি তার গোটা সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিল। সীমান্ত থেকে দেশের ভেতরে দশ-পনেরো মাইল, কোথাও কোথাও ত্রিশ-চল্লিশ মাইল পর্যন্ত বড় বড় সড়কের উপর অসংখ্য বাঙ্কার তৈরী করল এবং প্রধান প্রধান ভারতীয় ঘাঁটির মুখোমুখি ভারী কামান ও ট্যাঙ্কসহ পাক সেনাবাহিনীকে দাঁড় করিয়ে দিল।

 ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা তাই দেখে ভীষণ খুশি হলেন। তারা বুঝলেন পাখি ফাঁদে পা দিয়েছে। নিয়াজি তার সেনাবাহিনীকে দেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে, গোটা সীমান্তটা রক্ষা করতে চাইছে এবং বুঝতেই পারছে না যে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিলে ভারতীয় সেনাবহিনী ঠিক কোন দিক দিয়ে এগোবে। বাংলাদেশে নিয়াজির হাতে তখন পাক সেনাবাহিনীর প্রায় ৪২টা নিয়মিত ব্যাটালিয়ন। ৩৫ ব্যাটালিয়ন পাকসেনা এবং ৭ ব্যাটালিয়ন পশ্চিম পাকিস্তানী রেনজার। আর আধা সামরিকদের মধ্যে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আরমড ফোরসেসের ১৭টা উইংগ এবং ৫ উইংগ মোজাহেদ। অর্থাৎ মোট নিয়মিত সৈন্য প্রায় ৪০,০০০। এবং আধা সামরিক বাহিনীতে প্রায় ২৪,২০০ লোক। এছাড়াও পাক কর্তৃপক্ষের হাতে বাংলাদেশে আরও প্রায় ২৪,০০০ ইনডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স ছিল। মোট সৈন্য ছিল মাত্র ৪২ ব্যাটালিয়ন; কিন্তু নামে ডিভিশন ছিল চারটা। ১৪, ৩৯, ৯ ও ১৬। এছাড়াও ৩৬নং ডিভিশন নামে আর একটা ডিভিশন ছিল মেজর জেনারেল জামসেদের অধীনে। প্রধানত আধা-সৈনিকর এই ডিভিশনের আওতায় ছিল।

 সীমান্তের চতুর্দিকে এই বাহিনীকে সাজিয়ে দিয়ে নিয়াজি বেশ একটু পরিতৃপ্ত হলেন। তার হাতে তখন গুলিগোলা প্রচুর। নিয়াজি যত সৈন্য চেয়েছিল পাক কর্তৃপক্ষ কখনো তা তাকে দেয়নি, তার চাহিদা মত ট্যাঙ্ক, বিমান ও কামানও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসেনি। কিন্তু পাকিস্তানের কর্তারা নিয়াজিকে গোলাবারুদ দিতে কোন কার্পণ্য করেনি। যা চেয়েছিল তার চেয়েও বেশী দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন থেকে পাঠান প্রচুর গোলাগুলি তখন পাক কর্তৃপক্ষের হাতে। নিয়াজির নবম ডিভিশন তখন যশোরের ঘাঁটিতে। নবম ডিভিশনের সৈন্যরা সাতক্ষীরা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে দাঁড়াল। ষোড়শ ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার প্রথমে ছিল নাটোরে। সরিয়ে সেটাকে নিয়ে আসা হল বগুড়ায়। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের মধ্যবর্তী অঞ্চলের সমগ্র সীমান্তে ষোড়শ পাক ডিভিশনের সৈন্যরা বাঙ্কার করে বসল। ১৪ এবং ৩৯ নং ডিভিশনের ভাগে পড়ল পূর্ব সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব। উত্তর সীমান্তের জামালপুর থেকে দক্ষিণে কক্সবাজার পর্যন্ত ১৪ এবং ৩৯ নং ডিভিশনের সৈন্যরা ছড়িয়ে।

 বাংলাদেশের পাকবাহিনীর হাতে ছিল ৮৪টি মার্কিন স্যাফি ট্যাঙ্ক। আর ছিল শ আড়াই মাঝারি বা ভারী কামান। নিয়াজি তাও সব সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে এল। এবং দৃশ্যমান প্রধান প্রধান ভারতীয় ঘাঁটিগুলির মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য এর প্রায় সব কিছু নিয়ে জড় করল পাঁচটা কেন্দ্রে—চৌগাছা, হিলি, জামালপুর, সিলেট এবং আখাউড়ায়। দু'পক্ষই বুঝেছিল যা হওয়ার শীতকালেই হবে। তাই দুপক্ষই অক্টোম্বর- নভেম্বর মধ্যেই সীমান্তে সৈন্য সামন্ত সাজিয়ে বসল। ওদিকে তখন খোদ পাক সৈন্যবাহিনীও গেরিলাদের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত। গোটা সীমান্ত বরাবর এলাকায় রাত্রে পাক সৈন্যবাহিনীর পক্ষে চলাফেরা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। নিয়াজি বুঝল এবার একটা বড় দরের কিছু না করতে পারলেই নয়। তখন সীমান্তেও তার ন্যৈবাহিনী দাঁড়িয়ে গিয়েছে। নিয়াজির বুকে তাই বেশ বল। হাজার হাজার লোককে বেগার খাটিয়ে গোটা সীমান্ত জুড়ে হাজার হাজার বাঙ্কারও তৈরী হয়ে গিয়েছে। পাক সেনাবাহিনীর লোকজনেরা সেই সব বাঙ্কারে পজিশনও নিয়ে নিয়েছে। নিয়াজি তাই নতুন হুকুম দিল; প্রয়োজনে সীমান্তের ওপারে গিয়ে মুক্তিবাহিনীকে ঘায়েল করে এস।

 নভেম্বরেই শুরু হয়ে গেল পাক সেনাবাহিনীর ভারতীয় সীমা অতিক্রম। সর্বত্র এই ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করল। চবিবশ পরগণায়, নদীয়ায়, দিনাজপুরে, কোচবিহারে, আসামের বিভিন্ন প্রান্তে এবং ত্রিপুরার নানা অঞ্চলে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনী অর্থাৎ বি, এস, এফ’ও সঙ্গে সঙ্গে এর প্রত্যুত্তর দিতে আরম্ভ করল। শুরু হয়ে গেল সীমান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে গোলাগুলি বিনিময়। এবং প্রায় প্রতিদিনই এই জিনিস বেড়ে চলল।