পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
545

নভেম্বর শেষাশেষি এই অঞ্চলে একটা পুরোদমের লড়াই- ই শুরু হয়ে গেল। প্রথম প্রথম ভারতীয় সেনাবাহিনী শুধু ঘাঁটিতে বসেই পাকিস্তানী গোলার জবাব দিচ্ছিল। কিন্তু যে মুহুর্তে ওরা ট্যাঙ্ক নিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করল ভারতীয় বাহিনী ও তখন ট্যাঙ্ক নিয়ে এগিয়ে গেল। ২৫, ২৬ ও ২৭ নভেম্বর গোটা অঞ্চল জুড়ে বড় ট্যাঙ্কের লড়াই হয়ে গেল। এবং শেষদিনের লড়াইয়ে পাক সেনারা এত মার খেল যে ধামরাহাটের দিক থেকে পালাতে বাধ্য হল। এই যুদ্ধে পাকিস্তান মোট পাঁচটা ট্যাঙ্ক হারলো। কিন্তু ট্যাঙ্ক হারিয়ে বা লড়াইয়ে বড় মার খেয়ে ও পাকবাহিনী হিলি ষ্টেশনের ঘাঁটি ছাড়তে চাইল না। ভারতীয় সেনাবাহিনী অবশ্য হিলি ষ্টেশন দখল করার জন্য তেমনভাবে অগ্রসর ও হল না।

 এইভাবে গোটা সীমান্তে অঘোষিত লড়াই চলতে চলতেই শুরু হয়ে গেল পুরোপুরি যুদ্ধ - ঘোষিত হল পাক - ভারত লড়াই। এবং লড়াই ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের চতুর্দিক দিয়ে এগিয়ে গেল ভারতীয় সেনাবাহিনী আর বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। নিয়াজি তখন চোখে সর্ষে ফুল দেখল। এবং এই সর্ষে ফুলেই বাংলাদেশের পাক সেনা নায়ক ইসলামাবাদ থেকে পূর্ণ যুদ্ধের খবর পেয়েও তারা রণকৌশল পাল্টালো না। তখনও তার সেনাবাহিনী এবং কামান-বন্দুক গোটা দেশের সীমান্তেই ছড়ানো রইল। এবং তখনও নিয়াজি সীমান্তের ভারতীয় সেনাবাগহনীকে প্রতিহত করার জন্য ব্যগ্র। এর মধ্যেও কিছুটা বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিল পাক নবম ডিভিশনের প্রধান জেনারেল আনসারি। তার সদর ঘাঁটি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল আর ও বেশ কিছুটা ভেতরে-মাগুরায়। শোনা যায় সেটাও প্রধানত কামানের গোলা খাওয়ার ভয়ে। গরীবপুরের লড়াইয়ের পর খোদা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট ভারতীয় কামানের রেঞ্জের মধ্যে এসে গিয়েছিল। নবম পাক ডিবিশনের হেডকোয়াটার যশোর থেকে সরলো; কিন্তু সৈন্যসামন্ত যেমন সীমান্তে ছিল তেমনি রইল। তখনও পাক সেনানায়কদের সংকল্প, বাঙ্কারে বসে গোরা চালিয়েই পাক-সৈন্যরা ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করবে।

 যে কোনও মুহুর্তে পাকিস্তান সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, এ খবর নভেম্বরের শেষদিকেই ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী পেয়েছিল। তাই যে কোন মুহুর্তে লড়াইয়ে নামার জন্য ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনীও প্রস্বত্তত ছিল। ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিমান যখন অতর্কিত ভারতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন তার জবাব পেতেও মোটেই দেরি হল না। দুই সীমান্তেই জবাব পেল সঙ্গে সঙ্গে। পূর্বেও। পশ্চিমেও।

 ৩ ডিসেম্বর: ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৩ তারিখ রাত্রেই ভারতীয় সেনাবাহিনী চতুর্দিক দিয়ে বাংলাদেশের ঢুকে পড়ল। নবম ডিভিশন এগালো গরীবপুর, জগন্নাথপুর দিয়ে যশোর-ঢাকা হাইওয়ের দিকে। চতুর্থ ডিভিশন মেহেরপুরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল কালিগঞ্জ-ঝিনাইদহের দিকে। বিংশতিতম ডিভিশন তার দায়িতু দুভাগে বিভক্ত করে নিল-একটা অংশ রইল হিলির পাক ঘাঁটির মোকাবিলা করার জন্য। আর একটা অংশ হিলিকে উত্তরে রেখে এগিয়ে চলল পুবে। ষষ্ঠ ডিভিশনও তিনভাগে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হল-একটা তেতুলিয়া থেকে ঠাকুরগাঁর দিকে, আর একটা পাটগ্রাম থেকে কালীগঞ্জের মুখে এবং তৃতীয়টা কোচবিহার থেকে নাগেশ্বরী-কড়িগ্রামের দিকে। উত্তরে মেঘালয়ের দিকে যে দুটাে ব্রিগেড তৈরী হয়েছিল তারাও ওই রাত্রিতেই এগিয়ে গেল। একটা ঢালু থেকে নেমে এগিয়ে গেল জামালপুরের দিকে। আর একটা, এক বিশেষ উদ্দেশ্যে, একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল হালুয়াঘাটের মুখোমুখি।

 পূর্ব দিক থেকেও একই সঙ্গে ৮, ৫৭ এবং ২৩ নং ডিভিশন নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকল। একটা বাহিনী এল সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটের দিকে। ছোট ছোট তিনটা বাহিনী এগিয়ে চলল হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের পথে। আখাউড় কে সোজাসুজি আঘাত করে একটা গোটা ব্রিগেডই এগিয়ে চলল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে।

 ওদিকে কুমিল্লায় ময়নামতি ক্যাণ্টমেণ্টে পাকিস্তানীদের বেশ একটা শক্ত ঘাঁটি ছিল। কমিল্লা সেক্টরের দায়িত্ব ছিল আমাদের ২৩ নং ডিবিশনের উপর। যুদ্ধ শরু হতেই ডিভিশন কুমিল্লা শহরকে পাশ কাটিয়ে।