পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
546

এগিয় চলল দাউদকান্দির দিকে। ময়নামতি ক্যাণ্টমেণ্টের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য রেখে গেল মাত্র কয়েক কোম্পানি সৈন্যকে। এই ২৩নং ডিভিশনেরই আর একটা ব্রিগেড চৌদ্দগ্রাম থেকে অগ্রসর হল লাকসামের দিকে লক্ষ্য চাঁদপুর। পাকবাহিনীও এই আক্রমণ আঁচ করে লাকসাম একটা শক্ত ঘাঁটি তৈরী করে রেখেছিল। এখানেও ভারতীয় বাহিনী সেই একই কৌশল নিল। লাকসামের পাক ঘাঁটিকে ব্যস্ত রাখার জন্য একটা ছোট্ট বাহিনীকে রেখে কলামটা এগিয়ে চলল চাঁদপুরের দিকে। পুরে এর একটা বড় বাহিনী এগালো বিলোনিয়া দিয়ে ফেনীর দিকে। লক্ষ্য চট্টগ্রাম যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেওয়া। এই বাহিনীরও সেই একই কৌশল। ফেনীতে পাকিস্তানীরা বেশ শক্ত ঘাঁটি তৈরী করেছিল। শুরুতেই সেই ধখল করার জন্য ভারতীয় বাহিনী কোনও চেষ্টা করল না। একটা ছোট্ট বাহিনী রেখে যাওয়া হল ফেনীর পাক সৈন্যদের ব্যস্ত রাখার জন্য। আর মূল বাহিনীর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল দক্ষিণ পশ্চিম। পশ্চিম প্রান্তে বিমান হামলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিমান এবং নৌবাহিনী ও আসরে নেমে পড়ল। বাংলাদেশের ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর অ্যাকশন শুরু হল ৩রা মধ্যরাত্রি থেকে। বিমান ও নৌবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালাল। প্রধান লক্ষ্য ছিল অবশ্য ঢাকা ছিল পাক বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এই ঘাঁটিতে ছিল তাদের জঙ্গী বিমানগুলি। প্রথমে বাংলাদেশে পাক বিমান বাহিনীতে ছিল দুই স্কোয়াড্রন মার্কিনী স্যাবর জেট। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন ইয়াহিয়া খাঁর নিদেশে মিগ-১৯ বিমানগুলি পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হল। বাংলাদেশে থাকল শুধু স্যাবরগুলি। তারও কয়েকটা ঘায়েল হয়ে গিয়েছিল বয়রার লড়াইয়ে।

 বাংলাদেশের কাজে নেমেই ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য হল পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানগুলিকে শেষ দেওয়া-যাতে অন্তরীক্ষে শত্রপক্ষ কিছুই না করতে পারে, যাতে লড়াইয়ের শুরুতেই আকাশটা মিত্রপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

 সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ৩রা মধ্যরাত্রে ভারতীয় বিমান বাহিনী একেবারে তেজগাঁও আক্রমণ করল। ঐ বিমানবন্দরেই পাকিস্তানের সব জেট মজুত ছিল। কারণ গোটা বাংলাদেশের তখন ওই একটি মাত্র বিমানবন্দর যেখান থেকে বিমান উড়তে পারে। ভারতীয় মিগ সেই ঘাঁটিতে হানা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী স্যাবার জেট গুলিও বাধা দিতে এগিয়ে এল। প্রায় সারারাত ধরে চলল ঢাকার বিমানযুদ্ধ। পথম রাত্রির আক্রমণেই পাকবাহিনীর অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে গেল। বিমানবন্দর এবং কুর্মিটোলা ক্যাণ্টনমেণ্টও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল।

 ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর বিমানগুলি সেদিন যে শুধু ঢাকা আক্রমণ করেছিল তাই নয়। আক্রমণ করেছিল কুমিল্লা, চাঁদপুর, নারায়লগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং চাঁদপুরের অভিযান চালিয়েছিল প্রধানত নৌবাহিনীর বিমানগুলি। চট্টগ্রাম নৌবন্দরের প্রায় অর্ধেকটাই ধ্বংস হয়ে গেল। বন্দরের তেলের ডিপোগুলিও জুলে উঠল দাউ দাউ করে।

 এর মধ্যে পাক বিমান বাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি একবার কলকতা শহরেও হানা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রতিবারই তাদের ফিরে যেতে হল। আমাদের বিমান বাহিনীর বিমানগুলি সেদিন প্রায় রাত ধরে কলকাতা শহরকে পাহারা দিয়েছিল।

 ৪ ডিসেম্বর সকালে প্রতিরক্ষা দফতরের প্রধানরা আলোচনায় বসে দেখলেন ভারতীয় বাহিনী পূর্বখণ্ডে ঠিক ঠিকই এগিয়েছে। প্রথমত, তারা কোথাও শহর দখলের জন্য অগ্রসর হয়নি।

 দ্বিতীয়ত, কোথাও শক্ত পাক ঘাঁটির সঙ্গে বড় লড়াইয়ে আটকে পড়েনি।