পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
550

পালাল খুলনার দিকে। পালাবার সঙ্গে সঙ্গে সবকটা বাহিনীই রাস্তায় ওপারের সব ব্রীজ ভেঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করল। শ্রীহট্রেরও তখন প্রায় একই অবস্থা। দুপাশ দিয়ে এগিয়ে মিত্রবাহিনীর শ্রীহট্রের পশ্চিমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্বদিক থেকে একটা গোলান্দাজ বাহিনীও শ্রীহট্রের উপর গোলাবর্ষণ করে চলেছে। শ্রীহট্টের পাক সমরনায়ক পুল ব্যাক অর্ডার পাওয়া মাত্র পিছিয়ে যাওয়া চেষ্টা করল। ইচ্ছা ছিল আশুগঞ্জ থেকে মেঘনা অতিক্রম করে ঢাকার দিকে যাবে। কিন্তু পারল না। কিছুটা পিছিয়েই দেখল,সম্ভাব নয়-মিত্রবাহিনী তার আগেই পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। তখন গোটা বাহিনীটাকে দুভাগে ভাগ করা হল। একটা থাকল শ্রীহট্রে। আর একটা পেছনের দিকে দাঁড়িয়েছে। তখন গোটা বাহিনীটাকে দুভাগে ভাগ করা হল। একটা থাকলে শ্রীহট্রে। আর একটা পেছনের দিকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করল। দু’ দলই লড়াইয়ে হেরে গেল। শ্রীহট্রের বাহিনীটা বাঙ্কারে বসে ভালই লড়ল। ওই বাহিনীকে ঘায়েল করতে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে ও বেশ কয়েক টন বোমাবর্ষণ করতে হল। সমগ্র বাংলাদেশেই মিত্রবাহিনী তখন দ্রুত এগিয়ে চলেছে। তখন ও এই লক্ষ্যযাতে পিছু হটে গিয়ে পাকবাহিনী কোথাও না জড় হতে পারে, যাতে সীমান্তের কোনও পাকসৈন্য না ঢাকায় পৌছতে পারে।

 ৭ ডিসেম্বর: কার্যত যশোরের পতন হয়েছিল আগের দিনই। ৬ তারিখ সন্ধ্যা হত না হতেই পাকবাহিনীর সবাই যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। কিন্তু ভারতীয় বাহিনী তখনই সে খবরটা পায়নি। ৭ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে এগারটা নাগাদ ভারতীয় নবম ডিবিশনের প্রথম কলামটা উত্তর দিক দিয়ে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের কাছে এসে পৌছল। তখনও তারা জানে না যশোর ক্যাণ্টমেণ্টর শূন্য। তখনও তাদের কাছে খবর, পাকবাহিনী যশোর রক্ষার জন্য বিরাট লড়াই লড়বে। কিন্তু মিত্রবাহিনীর কলামটা যতই এগিয়ে এল ততই আশ্চর্য হয়ে গেল। কোন ও প্রতিরোধ নেই। সামনে থেকে একটাও গোলগুলি আসছে না।প্রায় বিহবল অবস্থায় যখন কলামটা একেবারে ক্যাণ্টেনমেণ্টর সামনে এসে দাঁড়াল তখন বুঝতে পারল ব্যাপারটা। জন্য দশ-পনেরো লোক ‘জয়বাংলা” ধ্বনি দিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। জড়িয়ে ধরে তাদের সম্বর্ধনা জানাল। আর জানাল যে, আগের দিন সব পাকসেনা যশোর ছেড়ে পালিয়েছে। ভারতীয় বাহিনী তখন গোটা ব্যাপারটা বুঝল। দেখতে দেখতে বেশ লোক এসে সেখানে জড় হল। তারাই ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরটা চিনিয়ে দিল ভারতীয় বাহিনীকে। পাক সেনারা যে ট্যাঙ্ক,কামান এবং ট্রাক-জিপ নিয়ে খুলনা পালিয়েছে যশোরের নাগরিকরা তাও ভারতীয় বাহিনীকে জানাল। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় বাহিনী ছুটল খুলনার পথে।

 ওদিকে তখন নবম ডিবিশনের সদর ঘাঁটিতেও সব খবর পৌছে গিয়েছে। ডিভিশনের প্রধান মেঃ জেনারেল দলবীর সিং বয়রা-ঝিকরগাছের পথ ধরে গোটা নবম ডিভিশনের নিয়ে এগিয়ে এলেন যশোর শহরে। যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট পাক নবম ডিভিশনরে মত আমাদের নবম ডিবিশনের সদর দফতর হল।

 শ্রীহট্টের ও পতন হল ওই দিনই দুপুরে। প্রথমে ভারতীয় ছত্রীসেনারা নামল শ্রীহট্রের নিকটবর্তী বিমানবন্দর শালুটিকরে। খুব ভোরে। তারপর চতুর্দিক থেকে মিত্রবাহিনী শ্রীহট্রের পাক ঘাঁটিগুলির উপর আক্রমণ চালাল। দুপুর বেলায়ই শ্রীহট্টের পাক সেনানায়ক আত্মসমৰ্পন করতে বাধ্য হল।

 ৮ ডিসেম্বর: বৃহস্পতিবার সকালে মিত্রপক্ষের সামরিক নেতার পূর্ব রণাঙ্গনের সমগ্র পরিস্থিতিটা বিশ্লেষণ করে দেখলেন, তাঁদের প্রথম লক্ষ্য সফল হয়েছে। বাংলাদেশের নানা খণ্ডে পাক সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ। ঢাকার দিকে পালাবার কোন পথ নেই। দক্ষিণে একটা পাকবাহিনী আটকে পড়েছে খুলনার কাছে। ওরের গোটা পাকবাহিনী ও ব্রক্ষপুএ এবং পদার মধ্যবর্তী তিন-চারটা অঞ্চলে অবুরুদ্ধ। একটি বড় বাহিনী, প্রায় একটা ব্রিগেড, হিলির কাছে অবরুদ্ধ। আর একটা ব্রিগেড আটকে রয়েছে জামালপুরে। ময়মনসিংহ থেকে যে বাহিনীটা সরিয়ে শ্রীহট্রের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সিটা কার্যত ফিনিসড। ময়নামতি ক্যাণ্টনমেণ্টে অবরুদ্ধ আর একটা ব্রিগেড। আর একটা বড় পাকবাহিনী অবরুদ্ধ চট্টগ্রামে। একের সঙ্গে আর একের যোগ দেওয়ার কোন ও সুযোগ নেই। ঢাকার দিকে পিছু হটাও কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।