পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
553

অভাবনীয় উপায়ে। রাশিয়ান ট্যাঙ্ক সাঁতরাতে পারে ঠিকই। কিন্তু একনাগাড়ে আধঘণ্টার বেশী সাঁতরালেই ট্যাঙ্ক ভীষন গরম হয়ে যায়। অথচ মেঘনা পার হতে আধঘণ্টার অনেক বেশী সময় লাগবে। তখন ঠিক হল, ট্যঙ্কগুলি যতটা সম্ভব নিজেই সাঁতরে এগোবে। তারপর নৌকাতে দড়ি বেধে ট্যাঙ্কগুলিকে টেনে নদীর ওপারে নিয়ে যাওয়া হবে। স্থানীয় মানুষের অভূতপূর্ব সাহায্য ছাড়া এই বিরাট অভিযান কিছুতেই সার্থক হত না। ওখানের মানুষ যে যেভাবে পারল মিত্রবাহিনীকে সাহায্য করল। শত শত নৌকা নিয়ে এল তারা। সেইসব নৌকা বার বার মেঘনা পারাপার করল। যেখানে থেকে মিত্রবাহিনী নদী পেরিয়েছিল সেখানে কোনও রাস্তাঘাট ছিল না। সেটা ছিল জলা জমি এই জলা জমি দিয়ে কামান বন্দুক ঘাড়ে করে নিয়ে গিয়েছিল ওই এলাকার শত শত শত বাঙ্গালী। বেশ কয়েক মাইল হেঁটে তারপর তারা পৌঁছেছিল ভৈরববাজার-ঢাকা মূল সড়কে। এবং পরদিনই তারা রায়পুর দখল করে নিল।

 ওদিকে তখন উত্তরের বাহিনীটা ও দ্রুত এগিয়ে আসছে। ময়মনসিংহের কাছে পৌঁছে তার দাঁড়াল। খবর ছিল যে ময়মনসিংহের পাকবাহিনীর একটা ব্রিগেড রয়েছে। কিন্তু সে ব্রিগেড়টাকে যে আগেই ভৈরববাজারের দিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিত্রবাহিনীর একটা ব্রিগেড রয়েছে। কিন্তু সে ব্রিগেডটাকে যে আগেই ভৈরব্বাজারের দিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিত্রবাহিনী তা জানত না। তাই মিত্রবাহিনী ময়মনসিংহে বড় লড়াই করার জন্য সেদিনটা ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর ওপারে শম্ভুগঞ্জে অপেক্ষা করল। অন্যদিকে ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীও সেদিন পাক সেনাবাহিনীকে আরও ভয় পাইয়ে দিল। বিমান বাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি ঢাকা বেতার কেন্দ্রটিকে স্তব্ধ করে দিয়ে এল। কুরমিটোলার উপর বার বার রকেট আর বোমা ছুড়ল।

 নৌবাহিনীর বিমান আক্রমনে চট্টগ্রাম এবং চালনার অবস্থা ও তখন অত্যন্ত কাহিল। কয়েকটা ভর্তি হয়ে পাকবাহিনী বঙ্গোপসাগর দিয়ে পালাতে গিয়েছিল। একটা জাহাজে নিরগেক্ষ দেশের পতাকা উড়িয়েও কিছু পাকসৈন্য সিঙ্গাপুরের দিকে পালাচ্ছিল। সব ধরা পড়ল। কয়েকটা পাক বাণিজ্য জাহাজ ও মাঝ দরিয়ায় ঘায়েল হল।

 ১ডিসেম্বর: ১১তারিখ চতুর্দিকে পাক সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ল। বহু পাকঘাঁটির পতন হল সেদিন মুক্ত হল জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ, পিসপাড়া, দুর্গাদীঘি, বিগ্রাম এবং চণ্ডীপুর। বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করল। এক জামালপুরেই আত্মসমর্পণ করল ৫৮১ জন। চাঁদপুরের উত্তরে মতলববাজারও বহু পাকসৈন্য আত্মসমর্পণ করল। কিছু আবার পেছনের দিকে পাল তে গিয়ে মার খেল। যেমন জামালপুরের বাহিনীর একটা অংশ। জামালপুরের পাকবাহিনী বেশকিছুদিন ধরে ভাল লড়াই ই চালিয়েছিল। মাটি কামড়ে তারা লড়াই চালাচ্ছিল। এই লড়াইয়ে ভারতীয় জেনারেল গিল মারাত্মক আহত হলেন। কিন্তু ১১ তারিখ আর পারল না। একটা বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। আর একটা টাঙ্গাইলের দিকে পালাল।

 উত্তরে ১০১ নং কমিউনিকেশন জোনের একটা ব্রিগেড তখন ময়মনসিংহ দখল করে নিয়েছে। ময়মনসিংহ থেকে সোজা তারা ঢাকা এগাতে পারল না। কারণ রাস্তাটাই সোজা যায়নি। গিয়েছে টাঙ্গাইল ঘুরে। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার রেললাইনটা ছিল সোজাসুজি। কিন্তু পালাবার আগে পাকবাহিনী ব্রাহ্মপুত্রের ওপরের রেল সেতুটা ভেঙ্গে দিয়েছিল ওই পথের আরও কয়েকটা রেলপুল। তাই ভারতীয় বাহিনীকে টাঙ্গাইলের পথেই এগোতে হল। সেইটাই অবশ্য ছিল তাদের পরিকল্পনা।

 ওদিকে ভৈরববাজারের দিক থেকেও তখন এগিয়ে ৫৭ নং ভারতীয় ডিভিশন। কিছুটা এগিয়ে তারা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটা গেল নরসিংদীর দিকে। বিমান বাহিনীও তখন পুরোদমে আক্রমণ চালাচ্ছে। পাকিস্তানীরা মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনী হাত থেকে পালায় তো বিমান বাহিনীর হাতে গিয়ে পড়ে। বিমান বাহিনী সেদিন একমাত্র ঢাকাকে রেহাই দিল। কারণ ভারত সরকার আগেই ঘোষণা করেছিল, ওইদিন ঢাকাও করাচির উপর কোনও আক্রমণ করা হবে না। বিদেশীদের ঢাকা থেকে বের করে আনার জন্য আন্তর্জাতিক বিমান