পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
33

হিসাবে আমি এবং ভারতীয় বাহিনীর কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য করে চলছিলাম। আগেই বলা হয়েছে আমাদের এই যৌথ বাহিনীর নাম ছিলো 'কিলো ফোর্স”।

 ফেনী থেকে রওনা হওয়ার পথে পাকিস্তানের ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের সৈন্যদের মোকাবিলা হবে বলে আমরা জানতাম। পাকিস্তানী এই ডিভিশনের সঙ্গে কামান ও সাঁজোয়া বহরও ছিলো। আমার বা ভারতীয় বাহিনীর সাথে কোন ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র ছিলো না। এই কারণে ভারতীয় বাহিনী একটু সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমাদের মূল বাহিনী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পথে অগ্রসর হচ্ছিলো। একই সাথে একটি বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নকে চট্টগ্রাম পাহাড়ের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয় হাটহাজারী এবং চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করার জন্যে। এই জায়গাটি বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কয়েক মাইল উত্তরে। আর আমরা মূল বাহিনী মহাসড়ক পথে চট্টগ্রামের পশ্চিম দিক দিয়ে এগিয়ে চললাম।

 চট্টগ্রামের অগ্রাভিযান আমরা ছাগলনাইয়া মুক্ত করার পর ৭ই নভেম্বর ফেনী নদীর সেই স্মরণীয় শুভপুর সেতুর কাছে গিয়ে পৌছি। চট্টগ্রামের পথে আমাদের সামনে এটিই হচ্ছে সর্বশেষ প্রধান বাধা। অবশ্য এরপরও কয়েকটি ছোটখাটো সেতু রয়েছে। শুভপুর সেতুর কাছে গিয়ে দেখি পাকিস্তানীরা সুদীর্ঘ সেতুটির দুটি স্প্যান সম্পুর্ণ ধ্বংস করে রেখে গেছে। আমরা আরো খবর পাই যে তারা ৮ মাইল দুরে মিরেশ্বরাইতে গিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলেছে।

 তৎক্ষণাৎ ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যদের ডাকা হয়। তারা যৌথবাহিনীর যানবাহন ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র পার করার জন্য ফেনী নদীতে একটি প্লাটুন ব্রিজ তৈরী করার কাজে লেগে যায়। কিন্তু নতুন সেতুর জন্যে অপেক্ষা না করে আমার সৈন্য দলের একটি অংশকে নিয়ে আমি ৮ই ডিসেম্বর বিকেলে নৌকাযোগে নদী পার হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হই। স্বল্পতম সময়ে করেরহাটে আমার সেক্টর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে আমরা জোরারগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করি। ভারতের ব্রিগেড কমাণ্ডারও করেরহাট পৌঁছে যান। আমার এলাকায় যুদ্ধের জন্য রসদপত্র সংগ্রহই ছিল বড় সমস্যা। আমাদেরকে খাদ্য দ্রব্য এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের জন্য পুরোপুরি ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিলো। এগুলোর জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আবার তাদের পেছনের ঘাঁটির ওপর নির্ভর করতে হতো। এই ঘাঁটি ছিলো শুভপুর থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে। এই পথটুকুর অধিকাংশ স্থানই ছিলো আবার ভীষণ খারাপ। তাই আমাদের রসদ সরবরাহ ব্যবস্থায় একটা মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিলো। হয়তো এই কারণেই আমার সঙ্গের ভারতীয় ব্যাটালিয়নগুলো সাবধানে এগুতে চাইছিলো। ভারতীয় কমাণ্ডার যুদ্ধের সরঞ্জাম এবং রসদের সরবরাহ সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বেশি দূর সামনে অগ্রসর হতে চাইছিলো না। এদিকে শত্রুরা শুভপুর সেতু ধ্বংস করে আমাদের সকলকে আরো সংকটে ফেলে দিয়েছিলো। এই প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও আমরা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। জাতিসংঘে আমাদের জন্য ক্ষতিকারক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং পাকিস্তানের অনুকূলে মার্কিন ৭ম নৌবহরের সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পূর্বেই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় আমাদের চট্টগ্রাম পৌছতে হবে।

 ইতিপূর্বেই আমি মিরেশ্বরাইয়ের নিকট গেরিলা তৎপরতায় লিপ্ত আমার নিয়মিত কোম্পানী এবং মিরেশ্বরাই ও সীতাকুণ্ডু এলাকার সকল গেরিলা গ্রুপকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম যে, তারা যেন শত্রুর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। ৯ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে প্রতিটি গেরিলা দল মহাসড়ক অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। গ্রাম গ্রামান্তর থেকে তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সড়কের দিকে আসছিলো এবং এতে করে ২০ মাইল দীর্ঘ এবং ১০ মইল প্রস্থ জুড়ে এলাকায় এমন একটা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো যে, মনে হচ্ছিলো মুক্তিবাহিনীর পুরো একটি কোরই বোধ হয় আক্রমণ চালিয়েছে। সেই রাতেই পাকিস্তনীরা পশ্চাদপসরণের আদেশের জন্য অপেক্ষা না করেই পেছনের দিকে পালিয়ে যায়।

 এদিকে আমরা যখন একটি জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে টিকেয়ে রাখার জন্য লড়াই করছিলাম, আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে তখন চলছিল আরেক খেলা, কিছু আমাদের সমর্থনে আবার কিছু ছিলো আমাদের