পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
561

জায়গায় তারা ছোট ছোট পকেট বানিয়েছিলো। তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে রি-ইনফোর্স কংক্রিটের বাংকার বানিয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে তারা ঢুকে ছিলো। রাতের বেলাতো বেরুতো না-ই, দিনের বেলায়ও বেশীসংখ্যক লোক ছাড়া বেরুতো না। শত্রর তখন এই অবস্থা দাঁড়িয়েছিল।

 অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই শক্র যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। যাতে তাদের জান বাঁচে, জাতিসংঘের হস্তপেক্ষেপের পর একটা যুদ্ধবিরতি হয়, অবজারভার এসে যায় এবং জাতিসংঘের কাছে সমস্যাটি দিয়ে তাদের জান রাক্ষা হয়-শত্রপক্ষের এই ছলো প্রচেষ্টা। কারণ, তখন তারা নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলো যে তাদের পরাজয় একেবারে অনিবার্য। জাতিসংঘ যখন হস্তক্ষেপ করলো না তখন তারা একটা আন্তর্জাতিক যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালালো যাতে জাতিসংঘ এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। প্রথমে তারা আমাদের ঘাঁটি, পজিশন ও বেসগুলোর ওপর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা করে। সাথে সাথে তারা পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাঞ্চলেও গোলাগুলি শুরু করে।

 আরেকটি ব্যাপার আমি বলতে চাই। আমার কাছে বিমান ছিলো না। তবে শেষের দিকে কয়েকটি বিমান নিয়ে আমি ছোটখাটো একটি বিমানবাহিনী গঠন করেছিলাম। আমি যে বিমান পেয়েছিলাম তা ছিলো দু’টো হেলিকপ্টর, একটি অটার এবং আমার যানবাহনস্বরুপ একটি ডাকোটা। সেই আটার ও হেলিক্টারগুলোতে মেশিনগান লাগিয়ে যথেষ্ট সজ্জিত করা হলো। আমাদের যেসব বৈমানিক স্থলযুদ্ধে রত ছিলেন তাদের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে একটি ছোট বিমান বাহিনী গঠন করা হলো। এই বাহিনীর কৌশল ছিলো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘাঁটিতে হামলা করা এবং ইণ্টারডিকসন অর্থাৎ শত্রর যোগাযোগের পথকে বন্ধ করে দেবার জন্যে লক্ষ্যবস্তত্তর ওপর আঘাত হানা।

 আপনারা জানেন কিনা জানি না, শত্রর ওপর প্রথম যে বিমান হামলা হয়েছে তা বাংলাদেশের বীর বৈমানিকেরা করেছে। ২৬ শে মার্চ থেকে ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত যে যুদ্ধ হয়েছে তাতে যদিও আমাদের কাছে বিমান ছিলো না কিন্তু আমরা বিমান ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হেনেছি। শেষের দিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা সিলেট বিমান ঘাঁটিতে একটি সি-১৩০ বিমানের ওপর অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মেশিনগান চালায়। মেশিনগানের গুলিতে যদিও সি-১৩০ বিমানটি পড়ে যায়নি, তবে কোন রকমে ঢুলু ঢুলু করে চলে গিয়ে শমসেরনগরে নেমেছিলো এবং পরে অনেকদিন মেরামতে ছিল।

 প্রশ্নঃ ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সম্মিলিত বাহিনীর রণনীতি রণকৌশল কি ছিলো?

 জেনারেল ওসমানী: প্রথমেই এ কথা নিচ্ছি, শেষের দিকে অর্থাৎ ডিসেম্বরের আগে শেষ পর্যায়ে শত্রবাহিনী ভারতের উপর যথেষ্ট পরিমাণ হামলা শুরু করলো। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে ভারতীয়দের যুদ্ধে নামতে হবে-যদিও উপর থেকে তারা তখনো নির্দেশ পাননি। এমন কি শেষের দিকে যখন যশোর সীমান্তে ভারতের উপর হামলা হয়েছে তখনো উপর থেকে ক্লিয়ারেন্স আসোনি।

 একদিনের কথা আমার মনে পড়েছে। সেই অঞ্চলে যুদ্ধরত আমার মুক্তিবাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ হচ্ছে। আমাদের কাছে ট্যাঙ্ক ছিলো না। পাকিস্তানী ট্যাঙ্কগুলো ভারতীয় অঞ্চলের উপরও গোলাবর্ষণ করছে। আমি তখন ওদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা এর জবাব দিচ্ছেন না কেন? তারা বললেন, পলিটিক্যাল ক্লিয়ারেন্স নেই। তখন আমার নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনীর যোদ্ধারা অতি বীরত্ব ও কৃতিত্বের সহিত মোকাবেলা করেছে।

 ভারতীয় বাহিনী ৩রা ডিসেম্বর যুদ্ধে নামে। এবং শত্রু আত্মসমপণ না করা পর্যন্ত ১৩ দিন যুদ্ধ করেছিলেন। অবশ্য এর আগে তারা আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। ভারতীয় বাহিনীর যখন যুদ্ধে নেমে আসার সম্ভাবনা দেখো দিল তখন আমরা সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করে একটি রণনীতি অবলম্বন করি। সেই নীতি ছিলো যেহেতু ভারতীয়দের কাছে ট্যাঙ্ক, কামান ও বিমান রয়েছে সেজন্য যেখানে অধিক শক্তিশালী প্রতিরোধ রয়েছে এবং বড়