পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
34

বিরূদ্ধে। ৫ই ডিসেম্বর নিরাত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির জন্য যে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে ভেটো দেয়। পাকিস্তান যখন হেরে যাচ্ছিলো সেই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি মানা হলে ইসলামাবাদেরই তাতে সুবিধা হতো, আর আমরা যেটুকু অর্জন করেছিলাম তাও হারাতাম।

 এরপরের দিন অর্থাৎ ৬ই ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ঘোষণা করলে তা মুক্তিযোদ্ধাদের এবং বাংলাদেশের জনগণের মনোবলকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানের বন্দীশালায় আটক শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে সেদিন মিসেস গান্ধী বলেছিলেন, এই নবজাত রাষ্ট্রের যিনি জনক, বর্তমান মুহূর্তে আমাদের সমস্ত চিন্তা তাকেই কেন্দ্র করে।

 ৮ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সৈন্য প্রত্যাহারের একট প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হয়েছিলো। প্রস্তাবটির উদ্যোক্তা ছিলেন মার্কিন সরকার। বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানকে ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচানোর চন্য যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দিয়েছিলো। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের। বৃটেন, ফ্রান্স এবং অন্য ৮টি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে।

 সাধারণ পরিষদে মার্কিন প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়টি আমাদের কাছে তেমন বিস্ময়ের কিছু ছিলো না। এতে এমন কিছুই ঘটেনি যা আমাদের লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে। ভারত, পাকিস্তান কিংবা এই মহতী জাতি সংস্থার অন্যান্য সদস্য হয়তো এই প্রস্তাব মানতে বাধ্য। কিন্তু আমরা তখনো জাতিসংঘের সদস্য নই। এবং তাই এ প্রস্তাব মানতে বাধ্যও নই। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম নির্যাতিত বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষকে মুক্ত করতে। আমাদের এই লক্ষ্যে ছিলো অত্যন্ত পবিত্র আর সেই লক্ষ্যে অর্জনের প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম। এমনকি এ সময় যদি ৭ম নৌ-বহর পাকিস্তানের সহায়তা করার জন্য যে কোনোভাবে যুদ্ধজড়িয়ে পড়তো তবুও আমরা এই মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যেতাম। ৭ম নৌ-বহরের যুদ্ধে যোগদানের ফলে হয়তো বাংলার আরো অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাতো। কিন্তু মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ এ দুটোর কোনটিই তখন এ দেশের মানুষের অজানা কিছু নয়। পাকিস্তানের জন্যে এই যুদ্ধ ছিল নিছক জয় এবং পরাজয়ের। কিন্তু আমাদের জন্যে এই যুদ্ধ ছিলো জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার মরণপণ সংগ্রাম, অন্যথায় সম্পুর্ন নিশ্চিহ্ন হয় যাবার। এ যুদ্ধ আমাদের দেবে গৌরবময় জীবনের সন্ধান নতুবা মৃত্যু।

 ভারতের চীফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এসএইচএফ মানেকশ যুদ্ধের এক নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন ৮ই ডিসেম্বর থেকে। যৌথবাহিনীর সাফল্যে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে তিনি এক সময়োচিত মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ (সাইকোলজিক্যাল ওয়ার) শুরু করেন। তার ভাষণ পর্যায়ক্রমে বেতারে প্রচারিত হতে থাকে। অন্যদিকে এই ভাষন প্রচারপত্রের মাধ্যমে বিমানের সহায়তায় পাকিস্তানী অবস্থানসমূহের ওপর বিলি করা হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানী সোনাবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানদের উদ্দেশ্য মানেকশ তার বার্তায় সরাসরি বলেন, অস্ত্র সংবরণ করো, নইলে মৃত্যু অবধারিত। যৌথবাহিনী তোমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। তোমাদের বিমান বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস ও নিয়ে আর কোনো সাহায্য পাবে না। বন্দরগুলোও এখন অবরুদ্ধ, তাই বাইরে থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা। মুক্তিবাহিনী এবং জনগণ এখন প্রতিশোধ নিতে উদ্যত। তোমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। সেই সাথে তিনি তাদের এই আশ্বাসও দেন সময় থাকতে অস্ত্র সংবরণ করলে তোমাদের সৈনিকদের যোগ্য মর্যাদা দেয়া হবে।

 মুক্তিযোদ্ধারা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন একত্রে থেকে কাজ করে আসছিলো। ১০ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিনিয়র কমাণ্ডারের অধীনে ভারত এবং বাংলাদেশ বাহিনীর এক যৌথ কমাণ্ড গড়ে তোলা হয়।