পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
37

 মুক্তিযোদ্ধারা খবর নিয়ে এলো যে কিছু পাকস্তানী অফিসার ও সৈন্য কক্সবাজার হয়ে স্থলপথে পালাবার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ আবার জাহাজে করে কেটে পড়বার চেষ্টা করছে। কয়েকটি পাকিস্তানী জাহাজকে বিদেশী জাহাজের মতো রং লাগিয়ে এবং বিদেশী পতাকা উড়িয়ে ছদ্মবেশে পালাবার জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এই খবর ভারতের ইস্টর্ন ফ্লিটকে পাঠালে ইস্টার্ন ফ্লিট সতর্ক হয়ে যায়। ছদ্মবেশে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি পাকিস্তানী জাহাজ ভীক্রান্ত-এর গোলায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 বার্মা দিয়ে পাকিস্তানীদের পালাবার চেষ্টা বন্ধ করার জন্য এ সময়ে কক্সবাজারে একটি অভিযানের পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেই উদ্দেশ্যে রোম ফোর্স নামে এক নতুন বাহিনী সৃষ্টি হয়। এই বাহিনীতে ছিলো ভারতের ১/২ গুর্খা রাইফেলস এবং ১১ বিহার রেজিমেণ্টের দুটি কোম্পনী। মর্টার সজ্জিত এই বাহিনী ভারতের একখানি সওদাগরী জাহাজে ১৪ই ডিসেম্বর কক্সবাজারের উপকূলে গিয়ে পৌঁছে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় রোম ফোর্স তীরে অবতরণ করে। কিন্তু ঐ এলাকায় কোনো পাকিস্তনীকে অবশ্য তারা পায়নি।

 ১৫ই ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানের চীফ অব আর্মি স্টাফের কাছ থেকে নিয়াজী শেষ নির্দেশ লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ আত্মসমর্পণের যে শর্ত দিয়েছেন যুদ্ধ বিরতির জন্য তা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে এত নিয়াজীকে পরামর্শ দেয়া হয়। এই রাতেই দুটার মধ্য বাংলাদেশের যে সব স্থানে পাকিস্তানী সোনাদল অবস্থান করেছিলো নিয়াজী তাদেরকে ওয়্যারলেস যোগে যুদ্ধ বিরতি পালন এবং যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করা নির্দেশ জারি করে দেন।

 রাত শেষ হয়ে আসে। ১৬ই ডিসেম্বর শেষ রাতের দিকে ভারতীয় ৯৫ মাউণ্টেন ব্রিগেডের কমাণ্ডে নিয়োজিত ব্রিগেডিয়ার ক্রেয়ার নিয়াজীর হেড কোয়ার্টারের একটি অয়ারলেস মেসেজ ইণ্টারসেপট করেন। এই বার্তায় ভোর ৫টা থেকে নিয়াজী তার সকল সেনাদলকে যুদ্ধ বিরতি পালন করতে বলেছিলেন। ক্লেয়ার সাথে সাথে এই অয়ারলেস বার্তার কথা জেরারেল নাগরাকে জানিয়ে দেন পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর ব্রিগেড কমাণ্ডার এবং ডিভিশনাল কমাণ্ডার মিরপুর ব্রিজের কাছে দ্বিতীয় ছত্রী ব্যাটালিয়ন যেখানে অবস্থান করছিলো সেখানে পৌছান। সেখানে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় প্যারা ব্যাটালিয়ন থেকে তার জানতে পারলেন যে ভোর ৫টার পর ব্রিজের কাছে আর গেলাগুলি হয়নি। এরপর জেনারেল নাগরা তার একজন এডিসি এবং ভারতীয় ছত্রী ব্যাটালিয়নের একজন অফিসারকে শ্বেত পতাকাবাহী একটি জিপে করে ব্রিজের অপর পাড়ে পাঠিয়ে দেন। তখন বেলা ৯টা। জীপের আরোহীরা নিয়াজীর উদ্দেশে লেখা জেনারেল নাগরার একটি বার্তা বহন করছিলো। রণক্ষেত্রের করোতার পরিবর্তে বার্তাটিতে নাটকীয়তাই ছিলো একটু বেশী। জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী এবং জেনরেল নাগরা দুজন ছিলেন ব্যাক্তিগত জীবনে পরিচিত সম্ভবত তাই বার্তাটিতে ছিলো নরম সুর। প্রিয় আবদুল্লাহ আমি এসে পড়েছি। তোমার সব বাহাদুরী আর খেলা শেষ। আমার কাছে এখন আত্মসমর্পণ করবে, এই আমার উপদেশ। পাকিস্তানের জন্য সত্যই তখন সকল খেলা শেষ। নিজ বাহিনীর প্রতি যুদ্ধ বিরতি এবং আত্মসমর্পণ করার যে নির্দেশ নিয়াজি জারি করেছিলেন, ১৬ই ডিসেম্বর সকালেই তা ভারত সরকারকে জানিয়ে দেয়ার জন্য তিনি ঢাকাস্থ মার্কিন সামরিক এ্যাটচিকে অনুরোদ করেন। তার অনুরোধ যথারীতি ভারতে মার্কিন দুতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারকে জানানো হয়।

 চট্টগ্রাম এলাকায় আমরা তখন কুমিরার দক্ষিণে আরো কয়েকটি স্থান শত্রুমুক্ত করে ফেলেছি। আমাদের যাত্রা বিম্বিত করার উদ্দেশ্য এসব জায়গায় কিছুকিছু পাকিস্তানী সৈন্য অবস্থান করছিলো। পথের সকল বাধা পরাভূত করে ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা ভাটিয়ারীর শক্তিশালী শত্রু ঘাঁটির সম্মুখীন হই। একান থেকে ফৌজদারহাট এলাকা পর্যন্ত পাকিস্তানীরা দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলো। এখানে তাদের অধিকাংশ সৈন্য এবং সমরাস্ত্র এনেও মোতায়েন করেছিলো। আমাদের লক্ষ্য ছিলো কিভাবে এই কমপ্লেক্স আমরা ধ্বংস করতে পারি। যুদ্ধ করতে করতে ওরা যদি চট্টগ্রাম শহরে মধ্য দিয়ে গিয়ে অবস্থান করতে পারে তাহলে