পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
38

আমরা পড়বো বিপদে। বাড়িঘর অধ্যুষিত এলাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে প্রতিটি বাড়িই আত্মরক্ষাকারীর আড়াল হিসেবে কাজে লাগাতে পারবে। সেই পরিস্থিতিতে শহরের মধ্যে পা বাড়ানো আমাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়বে।

 তাই ফৌজদারহাট এবং চট্টগ্রামের মাঝখানে শত্রুদের অবরোধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নেই। উদ্দেশ্য ছিলো ভাটিয়ারী এবং ফৌজদারহাটে অবস্থান গ্রহণকারী সৈন্যরা যেন পেছনে গিয়ে শহরে প্রবেশ করতে না পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রু বাহিনীর পেছনে আমাদের সৈন্যরা তাদের পশ্চাদপসরণের পথ রুদ্ধ করে রাখবে এবং সামনে থেকে আমাদের অবশিষ্ট অংশ আক্রমণ চালাবে। অভিযানের এই পদ্ধতি কতটা “ঘাড়ে ধরে মুখে আঘাত করার মতো” বলা যেতে পারে। সেই অনুসারে ভারতের ৮৩ ব্রিগেডের দুটি ব্যাটালিয়ন ২ রাজপুত এবং ৩ ডোগরাকে পেছনের পথ বন্ধ করে দেয়ার জন্য পাঠানো হয়। ভারতের তৃতীয় আরেকটি ব্যাটালিয়ন সম্মুখে সমরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ব্যাটালিয়নের সাথে যোগ দেয়। পূর্বোক্ত ব্যাটালিয়ন দুটি রাতের আঁধারে সড়ক থেকে প্রায় ১৫ মাইল পূর্ব দিক দিয়ে পাহাড়ী রাস্তা ধরে ফৌজদারহাটের কিছুটা দক্ষিণে গিয়ে আবার সড়কে উঠবে এবং সেখানে রাস্ত বন্ধ করে অবস্থান গ্রহণ করবে এই ছিলো তাদের প্রতি নির্দেশ। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে অগ্রসরমান এই দলের মালামাল বহনের জন্য প্রায় ১২০০ বেসামরিক লোক জোগাড় করা হয়। প্রয়োজনীয় সব জিনিসই এই বাহিনীর সাথে থাকবে যাতে তারা অন্তত ৪ দিন চলতে পারে। খাদ্যদ্রব্য, গোলাবারুদ, ট্যাংক বিধ্বংসী কামান, মর্টার, মাটি খোঁড়ার সরঞ্জাম, রান্নার উনুন এবং অন্যান্য তৈজসপত্র এ পুরো দুটি ব্যাটালিয়নের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই বহন করতে হবে। এছাড়া বেসামরিক লোকজন যারা যাবে তাদের খাদ্য এবং কিছু জ্বালানি কাঠও সঙ্গে থাকবে।

 ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যার কিছু আগেই ব্যাটালিয়ন দুটি পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু করে। স্থনীয় কিছু লোক আগে আগে যেতে থাকে গাইড হিসেবে। এই অভিযানের সাফল্যের উপরই চট্টগ্রামে আমাদের চুড়ান্ত লড়াইয়ের ফলাফল নির্ভর করছে।

 ইতিমধ্যে আমার নির্দেশে মিরেশ্বরাই এবং সীতাকুণ্ড এলাকার প্রায় ২০০০ গেরিলা একত্র হয়ে কয়েকটি নির্ধারিত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। যথাসময়ে তাড়াও লড়াইয়ে যোগ দেবে। শহর এলাকা সম্পর্কে ভালো ভাবে জানে বলে রাস্তায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তারা খুব কাজে লাগবে। তাই এদেরকে একত্রিত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখলাম।

 ভাটিয়ারীতে ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমরা পাকিস্তানীদের প্রথম রক্ষাব্যূহের ওপর আক্রমণ চালাই। দুটি কোম্পানীর এই আক্রমণ ওরা প্রহিত করে দেয়, আমাদের পক্ষে হতাহত হয় ২জন। ১৬ই ডিসেম্বর অগ্রবর্তী দলটি শত্রুর পেছনে ব্যারিকেড সৃষ্টি করার পরই আমাদের আসল আক্রমণ শুরু হবে। তাই আমরা পরের দিন প্রধান হামলা চালাবার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করি।

 ঢাকার অদূরে ভারতীয় জেঃ নাগরা যে দুজন অফিসার জেঃ নিয়াজীর কাছে পাঠিয়েছিলেন তার ২ ঘণ্টা পর ১১টার দিকে ফিরে আসেন। তাদের জীপের পেছনে পেছনে একখানি গাড়ীতে করে আসেন পাকিস্তানের ৩৬ ডিভিশনের কমাণ্ডার চেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ। জেনারেল নিয়াজীর সরকারী প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এরপর নাগরা এবং আরো কয়েকজন অফিসারকে জামসেদের হেডকোয়ার্টারে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে তারা নিয়াজীর অফিসে যাওয়ার প্রাক্কলে নাগরা কলকাতাস্থ ইস্টার্ন কমাণ্ডের হেডকোয়ার্টার এবং ৪র্থ কোরের হেডকোয়ার্টারের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে যথারীতি খবর পাঠিয়ে দেন। এর আগে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে নিয়াজী অয়্যারলেস যোগে মানেকশকে আত্মসমর্পণের সর্বশেষ মেয়াদ আরও ৬ ঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি আরো অনুরোধ করেন যে, আত্মসমর্পণের শর্তাবলী নির্ধারণ করার জন্য তিনি যেন একজন সিনিয়র ভরতীয় সামরিক অফিসারকে ঢাকা পাঠিয়ে দেন।