পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
39

 এতসব ঘটনা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। আমরা ভাটিয়রীতে তখন যুদ্ধে লিপ্ত। আমাদের অগ্রবর্তী দল সাফল্যের সঙ্গে পাহাড়ী পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কথা ছিলো ১৬ই ডিসেম্বর কোন এক সময়ে তারা শত্রুর পেছনের দিকে রাস্তা বন্ধ করে অয়্যারলেসে সে খবর আমাদেরকে জানিয়ে দেবে। আমরা সবাই তখন তাদের খবর শোনার জন্য রূদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলাম।

 নাগরার কাছ থেকে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের ইচ্ছার কথা জানতে পেরে জেনারেল অরোরা তার চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকবলকে বিমানযোগে ঢাকা পাঠিয়ে দেন। ততক্ষণ মিরপুর যৌথবাহিনী ব্রিজ পার হয়ে ঢাকয় প্রবেশ করতে শুরু করে। এ সময়ে নগরীর রাস্তাঘাট ছিলো জনমানবশূন্য।

 মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সৈন্যদের রাজধানীতে প্রবেশের খবর দাবানলের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লাসের জোয়ারে ঢাকার লক্ষ লক্ষ লোক নেমে আসে রাস্তায়। জনমানবহীন নিঃশব্দ নগরী মুহূর্তে ভরে উঠে মানুষের বিজয় উল্লাসে। ওরা এসেছে এই বাণী উচ্চারিত হতে থাকে মানুয়ের মুখে মুখে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ধ্বনি ওঠে জয় বাংলা সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। যৌথ বাহিনীর জন্যে মানুষ এগিয়ে আসে ফুলের ডালি নিয়ে হৃদয়ের গভীর আর ভালোবাসা নিয়ে।

 ঢাকায় সেদিন একদিকে চলছিলো মানুষের বিজয় মিছিল। তারই পাশাপাশি ছিলো পরাজিত পাকিস্তানীদের পলায়নের হাস্যকর দৃশ্য। কিন্তু মানুষ যে কতো জিঘাংসাপরায়ণ হতে পারে পাকিস্তানীরা তার এক নতুন নজীর সৃষ্টি করেছিলো। পালিয়ে যাবার সেই মুহূর্তেও পাকিস্তানীরা বিভিন্ন নিরীহ মানুষের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। ফলে বহু নিরীহ বাঙালী হতাহত হন।

 আত্মসমর্পণের একটি খসড়া দলিল সহ মেজর জেনারেল জ্যাকব বেলা ১টায় জেনালে অরোরার হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকা এসে অবতরণ করলেন। বেলা ২টা ৫০ মিনিটে জেনারেল অরোরা তাঁর সৈনিক জীবনের সবচাইতে আকাঙ্ক্ষিত বার্তাটি পেয়ে গেলেন। জীবনে খুব কমসংখ্যক সেনানায়কই এমন বার্তা পেয়েছেন। বার্তাটি ছিলো, নিয়াজী তার সেনাবাহিনীর সকলকে নিয়ে আত্মসমর্পণে রাজী হয়েছেন এবং আত্মসমর্পণের দলিলেও স্বাক্ষর করেছেন। পশ্চিম সেক্টরে পাকিস্তানী ৯ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনসারীর আত্মসমর্পণ পর্বর ততোক্ষণে সাঙ্গ হয়েছে। বিকাল ৩টার মধ্যে মুক্তিবাহিনীর শত শত তরুণ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড বিজয়ীর বেশে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য জেলারেল অরোরা তার বিমান ও নৌবাহিনীর চীফ অব স্টাফকে নিয়ে একটু পরেই ঢাকায় অবতরণ করলেন।

 আমার বিশ্বস্ত জেসিও সুবেদার আজিজ এবং ১৫ বছরের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা এতসব ঘটনার কিছুই অবহিত ছিল না। দুজনাই তখন ভাটিয়ারীতে অন্যান্যের সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ। পাকিস্তানীদের একটি খালের অপর পারে হটিয়ে দিয়ে পুনরায় আক্রমণ পরিচালনার জন্য তারা অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। অল্প বয়স্ক ছেলেটি কাছেরই এক গ্রামের। তাদের গ্রাম এর আগেই শত্রুমুক্ত হয়েছে। মা-বাবার সাথে দেখার করার জন্য ১৫ই ডিসেম্বর তাকে ১২ ঘণ্টার ছুটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সে প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলো, না স্যার। চট্টগ্রাম মুক্ত করার পরই আমি বাড়ি ফিরবো। কয়েকদিন বা আর লাগবে। আত্মসমর্পণের জন্য নিয়াজীর নির্দেশ তখনো তার সকল সেনাদলের কাছে পৌঁছেনি। আমরা জানতাম না যে, বেলা ৪টা ৩১ মিনিটে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হচ্ছে।

 চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৬ মাইল দূরে মহাসড়কের ওপর ভাটিয়ারী দখলের জন্য আমরা তখন লড়াই করছি। আক্রমণ চালাচ্ছে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানী। ঘড়িতে তখন বেলা ৪টা ৩০ মিনিট। ঢাকায় এবং অন্যান্য জায়গায় অস্ত্রের গর্জন থেমে গেছে। নিয়াজী এবং অরোরা হয়তো হাতে কলম নিয়ে আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করছেন। নিয়তির নির্মম পরিহাস। ঠিক সেই মুহূর্তে ঢাকা ঢেকে ১৬০ মাইল দূরে পাকিস্তনীদের একটি কামানের গোলা আমার অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধা এই কোম্পানীর মাঝখানে এসে পড়লো।