পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
41

 এমনি একটা সুন্দর মুহূর্তের জন্য সযত্নে এই প্যাকেটটি সাথে রেখেছি দীর্ঘ নয় মাস। এবার ওটাকে খুলে ফেললাম। সুন্দর করে ভাজ করা বাংলাদেশের পতাকাটি একটা কিশোর ছেলেরা হাতে দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলাম সার্কিট হাউসের ছাদে। সেখানে তখনো পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিলো। ছেলেটি পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় নিচে। সেখানে ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বেও প্রতীক জাতীয় পতাকা। সে সময় হাজার হাজার মানুষ দৌড়ে আসছে সার্কিট হাউসের দিকে। সমস্ত এলাকা ভরে গেছে মানুষের ভিড়ে। পতাকা উত্তোলনের সময় মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয় উত্তাল জনসমুদ্র অবিস্মরণীয় সেই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য। তারপর বাতাসের দোলা লাগে, উড়তে থাকে নতুন পতাকা। নিস্তব্ধ নতা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সেই জনসমুদ্রে ওঠে জয়ধ্বনি জয় বাংলা।

 পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী ধ্বংসের পথযাত্রী একটা জাতি পেয়ে গেল স্বাধীনতা। দুঃস্বপ্নের রাতের শেষে সেই পতাকার রক্তিম সূর্য বাংলার মানুষের জন্য নিয়ে এলো নতুন আশার বাণী। সমস্ত পৃথিবীতে সেই বিজয়ের বার্তা পৌছে দিতে যেন মানুষ এক যোগে মুহূর্মুহু স্লোগান দিতে থাকে জয় বাংলা। শহরের প্রতিটি প্রান্ত থেকে তেমনি আবেগে লক্ষ কণ্ঠ ধ্বনিত হতে লাগলো জয় বাংলা। খুলে গেল সমস্ত আবদ্ধ দুয়ার বাঁধভাঙা স্রোতের মত বেরিয়ে আসে সকল মানুষ। দীর্ঘ দিনের দুঃসহ যন্ত্রণার শেষে তারা উপভোগ করতে চাইলো উষ্ণ সূর্যালোক, মুক্ত বাতাস, সুন্দর সম্ভাবনাময় নতুন স্বাধীনতা। ভয়াবহ গণহত্যার মধ্য দিয়ে তারা বেঁচে থেকে স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করতে পারছে এ কথা যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তবুও সেই সব মানুষ বেঁচে আছে। মেঘমুক্ত নীল আকাশের নিচে সোনালী সূর্যের আলোকে মানুষ বিস্ময়ে চেয়ে থেকে বাংলার নতুন পতাকার দিকে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকাকে অভিবাদন জানিয়ে আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণের জন্য, অবাক বিস্ময়ে। ভুলে গেলাম আমার চারপাশের উত্তাল জনসমুদ্রের কথা। তখন ৯টা ১৫ মিনিট, ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১সাল।

 কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি ঘরে বিভিন্ন আকারের নতুন জাতীয় পতাকা শোভা পেতে লাগলো। শুধু ঘরের ছাদই নয়, গাছপালা, লাইটপোস্ট, দোকানপাট যেখানেই সম্ভব সেখানেই মানুষ উড়ালো নতুন পতাকা। উৎসবের সাড়া পড়ে গেলো সমস্ত শহরে। যুদ্ধের নয় মাস এমনি একটা সুন্দর মুহূর্তের জন্যে প্রায় প্রতিটি বাঙালীর ঘরেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো বাংলাদেশের পতাকা। ধরা পড়ে অনেকে আবার পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে।

 দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পৃথিবীর সবচাইতে বেদনাময় ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটলো হয়তো বা সাময়িকভাবে। এই নিষ্ঠুর ঘটনা ছিল অবিশ্বাস্য, আর তাই হয়তো এখানে কান্নায় ভাষারও হারিয়ে গিয়েছিলো। বিকৃত বিকারগ্রস্ত রক্তলিপ্সু পাকিস্তানীরা নিরীহ নারী-পুরুষ এবং শিশু হত্যার নৃশংসতায় হিটলারের নাজী বাহিনীকেও হার মানিয়েছিলো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির পক্ষ অবলম্বনকারী দুটি সরকার ছাড়া আর সমস্ত পৃথিবীর সরকার একযোগে রুখে দাঁড়িয়েছিলো হিটলারের গণহত্যার বিরুদ্ধে। অথচ বাংলাদেশের পাকিস্তনীরা যখন গণহত্যা চালালো তখন এইসব সরকারের কয়েকটি পাকিস্তনীদের বিরুদ্ধে না গিয়ে বরং ইয়াহিয়াকে গণহত্যায় সহায়তা করলো। একটা কঠিন সত্য পৃথিবীর মানুষের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ক্রমান্বয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনেকেরই নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। তাদের মুখে মানবতার বুলি আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

 বিজয়ের মধ্য দিয়ে নয় মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটলো। বাংলার মানুষ আবার তার নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করলো। পথে-প্রান্তরে পর্বতাঞ্চলে নদনদী খালে বিলে বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে বাঙালী আবার নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে। ছায়ার মতো অনুসারী মৃত্যুর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হবে না আর। রাতের অন্ধকারে প্রতিটি অচেনা শব্দ মৃত্যুর অশুভ পদধ্বনি হয়ে আসবে না। চারদিকে আনন্দ আর উল্লাসের ঢেউ। ২৫শে মার্চের সেই ভয়াভহ রাতের পর এই প্রথম মহিলারা নির্ভয়ে বেরুতে পারলো। ঘরের বাইরে ছোট