পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
42

ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ছুটে চলছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হাত মেলাতে। মার্চ করে চলছে মুক্তিবাহিনী। পথের দুই পাশে উচ্ছ্বসিত জনতা তাদের জানাচ্ছে প্রাণঢালা অভিনন্দন। সুখী মানুষের আনন্দ কোলাহলের সে এক অভূতপূর্ব সমাবেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছে কেউ। অনেকে গাইছে গান। নির্মল হাসিতে যেন সমস্ত মানুষের রূপ উদ্ভাসিত। কারো চোখে ছিল সুখের অশ্রুজল। একজন আনন্দের আতিশয্যে বাঁধ ভাঙা চোখের জল সামলাতে গিয়ে শাড়ির আঁচল কামড়ে রেখেছেন দৃঢ়ভাবে। কাছেই কোথাও মাইকে বাজছিল অতি প্রিয় সেই গান “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”। এমনি অনেক ফুলের মত জীবনকে হয়তো আমরা যুদ্ধ করে বাঁচাতে পেরেছি। আবার অনেকেই আমরা বাঁচাতে পারিনি। আমার মনে হলো সেই সব শহীদের কথা, যারা নিজ দেশে বন্দির মতো জীবন যাপন করছিলো। পাকিস্তানীরা এদেশকে পরিণত করেছিল বন্দীশালায়। যেখানে তার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে রেখেছিল বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে। সেই বন্দিশালায় পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত অসংখ্য মানুষের ত্যাগ আর গভীর জীবনবেদনা ছিল এতই মহান যে শ্রদ্ধায় নত হয়ে আমি অনুচ্চ স্বরে বললামঃ

“... এবং শান্তি, আর যুদ্ধ নয়-
তোমাদের বিদেহী আত্মার জন্য
চাই শুধু শান্তি, যুদ্ধ নয়।
এই বন্দীশালা, এখানেই ছিল
তোমাদের তীর্থের জীবন।”

 ইতিহাসের এই মর্মান্তিক নাটকের যবনিকাপাত সে কি বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত নাকি শোকের বেদনায় আপ্লুত? অথবা সেখানে ঘটেছে বিজয় আর বেদনার অপূর্ব সংমিশ্রণ? এই নির্মম ও অচিন্তনীয় গণহত্যাকে কি পৃথিবীর মানুষ ইতিহাসের পালাবদলের অমোঘ বিধান বলেই সমস্ত দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবে?

 সার্কিট হাউসের সামনে সবুজলনে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম সেই বিষাদময় সমস্ত ঘটনার কথা। যুদ্ধের নয় মাসের শহীদদের কথা আবার মনে পড়লো। পাকিস্তানীরা এদের হত্যা করেছিলো গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে শহরে-মসজিদে-মন্দিরে। অনেককেই ধরে নিয়েছিলো আরো নিষ্ঠুরভাবে অশেষ যন্ত্রনা দিয়ে হত্যা করার জন্য। বাংলার এই অসহায় মানুষগুলো আর কোনো দিনই ফিরে আসবে না। কিন্তু পাকিস্তানীরা যখন এদেরকে বেঁধে নিয়ে যেতো হত্যা করার উদ্দেশ্যে সেই মুহূর্তে এই সব অসহায় মানুষ কি ভাবতো কে জানে? তাদের আপজনেরই বা কি গভীর মর্মবেদনায় ভেঙ্গে পড়তো চিরবিদায়ের সেই মুহূর্তে? এইসব মানুষকে যখন পাকিস্তানীরা লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করতো, রাস্তায় টেনে নিয়ে যেতো জীপের পেছনে বেঁধে, বেয়োনেট আর রাইফেলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতো তখন মৃত্যুপথযাত্রী সেই সব মানুষ কি ভাবতো আমরা কোনো দিন তা জানবো না। নিষ্পাপ শিশু, অবলা নারী, অসহায় বৃদ্ধ এদের কেউই সেদিন রক্ষা পায়নি। পাকিস্তানীদের হাত থেকে।

 সেই সব প্রাণের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। আমার চিন্তায় বাধা পড়লো। একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন আমার দিকে। যুদ্ধে তার ছেলে হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। মুখে তাঁর হাসি নেই নেই অশ্রুজল। তিনি শান্ত, অতিশান্ত। আমাকে জড়িয়ে ধরে তিনি গভীর প্রশান্তিতে চোখ বুজে রইলেন কিছুক্ষণ।

 মানব হৃদয়ের সেই অব্যক্ত বেদনা কেউ কোন দিন বুঝতে পারবে না।