পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/২৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
২৪২

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণ একটি জাতি হিসাবে গড়ে উঠেছিল। সেখানে দাসপ্রথা রাখার অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল দাবিতে দক্ষিণ অঞ্চলের কিছু লোক জাতীয় রাষ্ট্র হতে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল। তাই সেটা ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সিসেসনিস্ট মুভমেণ্ট। বাংলাদেশের মানুষ আর পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এক জাতীয়তাবোধই গড়ে ওঠেনি। পাকিস্তানী পিপল ডিড নট ডেভেলপ অ্যাজ এ মোমোজিনিয়াস নেশন-কি জীবনধারার দিক থেকেই দেখুন, কি ভাষার দিক থেকেই দেখুন, এক জাতি মানসিকতা থেকে বলা হয়ে থাকে ওয়ান নেশন সাইকোলজিক্যাল মেকআপ হুইচ কনস্টিটিউটস দি মেন ফ্যাক্টর ইন দি ফরমেশন অফ এ নেশন। তার কোনটাই পাকিস্তানের উভয় খণ্ডের জনসাধারণের মধ্যে এক ও অভিন্ন নয়। এক ন্যাশনাল সাইকোলজিক্যাল মেকআপ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। এটা হয়ত কালক্রমে গড়ে উঠত যদি উভয় খণ্ড পরস্পর সংলগ্ন হত। তখনও সংখ্যাগরিষ্ট ন্যাশনালিটি কর্তৃক সংখ্যালঘিষ্ট ন্যাশনালিটির উপর জাতীয় নিপীড়ন থাকত এবং তার জন্য বিক্ষোভও থাকত যেমন আমাদের দেশে আছে। কিন্তু পাকিস্তানে তা নয়; সেখানে দুই খণ্ডের মধ্যে ফারাক ১২০০ মাইল। যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের উপর শোষণ চালিয়েছে তাই যখন সেটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে রূপ নিয়েছে একটা কলোনিয়েল এক্সপ্লয়টেশন, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শোষণ হিসাবে এক জাতি কর্তৃক ভিন্ন জাতিকে শোষণ করা হিসাবে। এক জাতীয়তাবোধ ও মানসিক গঠন না গড়ে ওঠার এটা ফল। বাংলাদেশের মানুষ তাই বার বার অনুভব করেছে যে, তারা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের দ্বারা ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসনে ভুগছে। সেই বোধ থেকেই নতুন বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের জন্ম এবং সেই কারণে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য তারা সংগ্রাম করছে। সেই সংগ্রাম এই কারণেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন; সেটা হচ্ছে স্ট্রাগল ফর কমপ্লিট ন্যাশনাল ইণ্ডিপেণ্ডেন্স অর্থাৎ পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। উত্থাপিত প্রস্তাবে সে বক্তব্য রাখা হয়েছে। এই সত্য যেন আমরা ভুলে না যাই। ভুলে গেলে এর গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারব না। আর তা ঠিকভাবে বুঝতে না পারলে এই সংগ্রামের প্রতি আমাদের যে কর্তব্য তাও আমরা করতে পারব না।

 একথা ঠিক যে, ভারতবর্ষ বিশেষ করে পশ্চিম বংলার সব মানুষ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের সংগ্রামকে দেখছে না। কারও কারও মনে উঠতে পারে দুই বাংলা হোক এবং সেই কারণে তারা বাংলাদেশের সংগ্রামের সমর্থক। কেউ কেউ মনে করতে পারে পাকিস্তান দুর্বল হোক এবং সেই মানসিকতার জন্য তারা বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করতে পারে। তবে আমি বলব যে এইভাবে ভাবলে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রামকে আমরা শক্তিশালী করার বদলে দুর্বলই করব। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলাকে যুক্ত করে আবার একটা অখণ্ড বাংলাদেশ গড়ার জন্য লড়ছে না। তারা এক জাতির মানসিকতা নিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতীয় রাষ্ট্র স্থাপন করবার জন্যই সংগ্রাম করে চলেছে। এ বোধ ও দাবি ভারতীয় জাতীয়তাবোধের প্রোডাক্ট নয়। একটি নতুন জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের সংগ্রাম। আমাদের সঙ্গে মিলে অখণ্ড বাংলা গড়ার জন্য তারা লড়ছে না।

 আমি কিছু কিছু সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় ও চিঠিপত্রের স্তম্ভ দেখেছি দুই বাংলা এক হোক, এই স্লোগান এখন দেওয়া হচ্ছে। এটা দেওয়া উচিত হবে না। আমার কথাকে ভুল বুঝে কেউ যেন না ভাবেন যে আমি দুই বাংলা এক হোক তা চাই না। নিশ্চয়ই চাই। তবে তা পারার পথ কি, তার পদ্ধতি কি হবে? তার পদ্ধতি কি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুর্বল করা? নিশ্চয় না। কোন সুদূরভবিষ্যতে দুই বাংলা এক হতে পারে এখন নয়। ভবিষ্যতে যখন আমাদের দেশে ও বাংলাদেশে, উভয় দেশেই সামাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হবে তখন উভয় দেশের মানুষ স্বেচ্ছায় যদি দুই বাংলাকে এক করতে চায় কেবলমাত্র তখন দুই বাংলা এক হবে। তার আগে দুই বাংলার এক হবার সম্ভাবনার কণামাত্রও নেই। আর উভয় দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেই যে এটা হবে তাও না। জাতীয় মনোভাব ও জাতীয় রাষ্ট্রের সামাজিক স্তর অতিক্রম করে সাম্যবাদী সামাজব্যবস্থা গড়ার পথেই তা সম্ভব হবে। একথা যদি আমরা আমাদের দেশের মানুষকে না বোঝাতে পারি তাহলে আমি মনে করি যে, উভয় বাংলা এক হোক এই স্লোগান তোলার দ্বারা পাক সরকারের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের