পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/২৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
২৫৬

করার কথা কেউ কেউ বলেছেন। আমি এইসবের মধ্যে না গিয়ে এই কথা বলতে চাই যে, বৃহত্তর স্বার্থের জন্য, মহৎ আদর্শ পালনের জন্য সীমান্তের ওপারে আমাদেরই ভাইবোন যারা আত্মত্যাগ করছেন, যারা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখবার আছে। যেদিন আমাদের নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন সেদিন এমনিভাবে এই বাংলাদেশের মত সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি সমস্ত কিছু বিভেদ অতিক্রম করে একটি মহত্ত্বের ঐক্য গড়ে উঠেছিল, আজকেও পূর্ববাংলায় অর্থাৎ বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়েছে। আমরা আজকে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে অনেক তর্ক করতে পারি, অনেক উৎসাহ দিতে পারি, অনেক রকম আলোচনা করতে পারি, কিন্তু এই কথা মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি মুহূর্তে সেখানে জীবন যাচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্তে সেখানে জীবন কোরবানি হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের আর এইসব তর্ক, বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। যে সমস্ত মাননীয় সদস্য সর্বপ্রকার সাহায্য দেবার কথা বলেছেন, আমি তাঁদের সেই বক্তব্যকে অভিনন্দিত করি। আমাদের স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করেই হোক, যেমন করেই হোক অর্থ, রসদ, অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি দেবার দাবী যেমন সরকারের কাছে দেব তেমনি বেসরকারীভাবে আমাদের যা কিছু করণীয় আছে তাই আমরা করবো। আমাদের পক্ষ আজকে এটা সৌভাদ্যের বিষয় এবং গর্বের বিষয় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামী, স্বাধীনতাকামী, শান্তিপ্রিয় মানুষদের সমর্থনের বিষয়ে আমাদের বক্তব্য আমরা রাখছি এবং যতটা করা দরকার ততটা করার চেষ্টা করছি। ভারত সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ যে, এই প্রস্তাব নিশ্চয়ই কার্যকরী করতে হবে এবং যাতে তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সত্বর লাভ করতে পারে এবং বাংলাদেশের এই নূতন সরকার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মর্যাদা লাভ করতে পারে নিশ্চয়ই আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সাহায্য দিয়ে, ত্রাণের ব্যবস্থা করে, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে সক্রিয়ভাবে যে ব্যবস্থা আমরা করতে যাচ্ছি সেটা কতদিন এই রকম চালিয়ে যেতে পারি তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এবং যত শীঘ্র সম্ভব বাংলাদেশের সরকার স্বীকৃতি লাভ করে আবার এই সমস্ত ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে যেতে পারবেন তার ব্যবস্থা হতে পারে, সেই জন্যই আমাদের অবিলম্বে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

 সেইজন্য আমাদের অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং এদের যুদ্ধে যাতে দ্রুত তারা সাফল্য লাভ করতে পারে, জয়যুক্ত হতে পারে তার জন্য প্রয়োজন হ’লে আমাদের যুদ্ধের মধ্যে যেতে হবে। আমরা যতই বৈষয়িক সমস্যায় জর্জরিত হই না কেন, এই সমস্যাকে আমরা কিছুতেই অবহেলা করতে পারি না বা ফেলে দিতে পারি না এবং দেখেও না দেখার ভান করতে পারি না। বাইরের অন্যান্য বৈদেশিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে দেরী করতে পারে কিন্তু আমাদের মোটেই দেরী করা উচিত হবে না বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে। আমরা বৈষয়িক স্বার্থের কথা, রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভাবতে পারি। কিন্তু আমাদের বোঝা উচিত এই রাষ্ট্র একদিন আমাদেরই অঙ্গ ছিল। আমরা যারা ১৯৪৬ সালের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিনগুলি দেখেছি তা কখনো ভোলা যায় না। সেই দিনগুলি ছিল কি ভয়ংকর! কি রকম রক্তাক্ত অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। আজকে কালের করাল প্রবাহে দ্বিজাতিতত্ত্ব যে কত অসার ও অর্থহীন তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। মানুষকে মানুষের ভাষার ঐক্য সামাজিক ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐক্যই ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে। সীমান্তের ওপারে আমাদের ভাইবোনেরা নিরস্ত্র হয়ে যে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করছে সশস্ত্র এক পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে তা তুলনাবিহীন। আমরা তাদের সেই যুদ্ধে সমর্থন জানাচ্ছি, আগেও জানিয়েছি, আজকে এই সভায় সরকার যে প্রস্তাব এনেছেন তা আমি সমর্থন করছি। এই প্রস্তাবকে কার্যকারী করবার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তার সহায়তা করতে থাকবো। এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া ধরে যে কথা কাটাকাটি হ’ল তা বাস্তবিকই খুব দুঃখজনক। মাননীয় সুবোধবাবু যে কথা বলেছিলেন তা অতি মর্মস্পর্শী। তিনি বহুদিনের সভ্য, লেজিসলেচারের ব্যাপারে তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা রয়েছে। আমরা যারা নতুন নির্বাচিত হয়ে এসেছি, আমাদেরও এই হাউসের কাজকর্ম ভালভাবে দেখা দরকার, শেখা দরকার। সমস্ত প্রস্তাবটি যাতে যথোচিতভাবে গুরুত্ব পায়, তাও দেখা দরকার। আমরা যারা জনগণের দ্বারা প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে এসেছি, আমাদের উপর জনগণ গুরুতর দায়িত্ব দিয়েছে। সেই দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা যেন সচেতন থাকি। জয় বাংলা।