পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/২৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
২৫৮

দেশ বহুজাতিভিত্তিক হয়, বহু জাতির সমন্বয়ে গঠিত হয়, সেই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার যদি সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে সমস্ত রাজ্যগুলির ওপর একেবারে একাধিপত্যের ও শোষণের রথ চালিয়ে যান, তাহলে সেই দেশ কালক্রমে ভাঙ্গতে বাধ্য। সেইসব দেশে বিভিন্ন জাতির ভিত্তিতে যে এক-একটি রাজ্য, সেই রাজ্যগুলিতে ব্যাপক স্বায়ত্ত্বশাসন-এর অধিকার দেওয়া প্রয়োজন; এ না হলে দেশের ঐক্যকে রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এই স্বায়ত্ত্বশাসন চেয়েছিল। এ না হলে দেশের ঐক্যকে রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এই স্বায়ত্ত্বশাসন চেয়েছিল। সেখানে ১৩ বছর ধরে মিলিটারি বুটের দাপট পাক সরকার চালান, গণতান্ত্রিক অধিকার তাদের জনগণের কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তবুও তারা মরেনি। ৫০ হাজার কি ৭০ হাজার মিলিটারি জনগণের বুকের উপর যদি বছরের পর বছর ধরে চাপিয়ে দেওয়া যায় তাতে কেউ যদি মনে করেন সেই দেশের প্রাণশক্তি ভেঙ্গে দেওয়া যায় তাহলে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন, যেমনভাকে পাক সামরিক চক্র মূর্খেস্বর্গে বাস করেছিলের ১৩ বছর ধরে। ২৫ শে মার্চের আগে মিলিটারি মেশিনগান চালিয়ে গণহতা শুরু করেনি; ১৩ বছর ধরে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বুকের উপর তারা চেপে বসেছে; এই তারা করেছে। জনগণ চেয়েছিল তার থেকে বাঁচতে। তাদের ৬-দফা দাবি ছিল; এখন কাগজ পড়লে ৬-দফা দাবি আর পাবেন না, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। তাদের কথা ছিল এই যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গভর্নমেণ্টের হাতে দেশরক্ষার মত সাধারণ কয়েকটি জিনিস থাকবে, বাকি সমস্ত ক্ষমতা বাংলাদেশের রাজ্যের হাতে থাকবে এবং এই দাবি শুধু বাংলাদেশের জন্য ছিল না, পাকিস্তানের প্রত্যেকটি রাজ্যের অধিকারের কথা তারা বলেছিলেন। এতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের অন্তরে সাড়া জেগেছিল। ওরা লড়াই চায়নি, ওরা চেয়েছিল ভোটের মাধ্যমে স্বায়ত্ত্বশাসন। পাকিস্তানের সামরিক চক্র তার জবাব দিলেন আক্রমণ করে। তারা মিলিটারিকে অর্ডার দিলেন- যে মিলিটারি ১৩ বছর ধরে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বুকের উপর চেপে বসেছিলতাদের অর্ডার দেওয়া হল, বাংলাদেশের উপর তোমরা গণহত্যা অভিযান শুরু করে দাও। শুধু কম্বিং করলে চলবে না, ‘এনসার্কিলিং’ করলে চলবে না, একেবারে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চালাও। ওখানে হচ্ছে তাই। দেড় মাসের মধ্যে যদি ১-২ লক্ষ লোক খুন হয়ে থাকে তাহলে এটা গণহত্যা ছাড়া আর কি? তারা স্বায়ত্ত্বশাসন, গণতন্ত্র চেয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে ভোটের ভেতর দিয়ে, তার জবাব এল মিলিটারীতে, মেশিনগানের গুলিতে। কি করতে পারত বাংলাদেশের মানুষ?— যদি তাদের মনুষ্যবোধ থাকে তাহলে তার একমাত্র উত্তর ছিল অস্ত্রের ঝঞ্ছনার উত্তর অস্ত্রের ঝঞ্চণায়। তাই হয়েছে তাই তো স্বাধীনতার দাবি এল। এই বিষয় আমাদের তুলে ধরা উচিত। এইটুকু যদি তুলে ধরতে পারি তাহলে পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে। কিন্তু এই সমর্থন একদিনে পাওয়া যাবে না- ভিয়েতনামের পক্ষে সমর্থন একদিনে পাওয়া যায়নি, সময় লাগবে। সেজন্য এটা নিয়মিত প্রচার করার দরকার আছে যে, বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দিতে চায়নি, তারা চেয়েছিল মানুষের মত মর্যাদা নিয়ে, গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে। তাদের খুন করে বাধ্য করা হল লড়তে। তাদের সামনে স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচার কোন পথ থাকল না। এটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে। পাকিস্তানের সামরিক চক্র প্রতিনিয়ত আর একটি বিরুদ্ধ প্রচার করছে এবং বাংলাদেশের ভেতরে কিছু দালাল সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তাদের দু'একটি নাম আপনাদের কাছে এসেছে। যেসব ভাইরা এখানে এসেছে, যেসব ভাইরা এখানে এসেছেন তাঁদের কাছ থেকে খবর পাচ্ছি যে, সেখানকার কিছু কিছু মানুষকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা হচ্ছে যে, ভারতবর্ষের যারা সমর্থক তারা পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চাইছে; বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় তাহলে বাংলাদেশ ভারতবর্ষের একটা অনুগত দেশ হবে। আমি আপনাদের বলছি, বাংলাদেশের প্রতি আমাদের সমর্থনের কদর্য করে পাক সামরিক চক্র আমার এখানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে এটা যেন না হয়। পাকিস্তানের সামরিক চক্রকে এই কথা বলতে চাই যে, একটা দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ যদি একবার অস্ত্র হাতে নিয়ে পাকিস্তানের আধুনিক অস্ত্রে সাজ্জিত সামরিক বাহিনীকে পর্যদুস্ত করতে পারে তাহলে আত্নমর্যাদাসম্পন্ন সে জাতি অন্য কোন জাতি বা অন্য কোন গভর্নমেণ্টের কাছে, তা সে যত চেষ্টাই করুক না কেন, যার মনে যতই আশা থাক না কেন, সে জাতি কোনদিন কারো কাছেমাথা নোওয়াতে পারে না। এইভাবে যদি পাকিস্তানের মিথ্যা প্রচার ব্যর্থ করতে পারি, তাহলে আমরা গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে পারবো।