পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/২৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
২৬৮

সর্বসম্মত প্রস্তাব করার যে প্রচেষ্টা করেছেন তাদের আমি আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমাদের দু’পক্ষের ব্যবধান যতই হোক না কেন, আজকের দিনে যদি একমত হয়ে একটা প্রস্তাব নিই, সেই প্রস্তাবের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক এবং সেই প্রস্তাব পাস হওয়ার একান্ত প্রয়োজনীয়তা ছিল। আজকে সর্বাগ্রে আমি মনে করি যে, সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে স্বাধীন বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি আপনারা জানেন। যে কয়টি শর্ত স্বীকৃত হলে আন্তর্জাতিক আইনে একটা রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া চলে, আর প্রত্যেকটি টেস্ট বা পরীক্ষাতেই এই স্বাধীন বাংলা উত্তীর্ণ হয়েছে। আইনে আছে আপনারা জানেন, টেরিটরি পপুলেশন, অর্গানাইজেশন সভরেণ্টি বোথ এক্সটার্নাল অ্যাণ্ড ইণ্টারন্যাশনাল, এই চারটি শর্ত যদি উত্তীর্ণ হতে পারে তবে যে-কোন রাষ্ট্র এবং যে-কোন জাতি আত্নানিয়ন্ত্রনের ভিত্তিতে স্বীকৃতি পেতে পারে। বিগত বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা জানি এই পূর্ব এশিয়াতে নেতাজী সুবাসচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দু সরকার গঠিত হয়েছিল, সেই আজাদ হিন্দ সরকারেরও স্বীকৃতি মিলেছিল আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে। পৃথিবীর ন’টি রাষ্ট্রের কাজ থেকে। এবং সেখানেও এই পপুলেশন, অর্গানাইজেমন, সভরেণ্টি, টেরিটরি, এই চারটি পরীক্ষাতে তার সরকার উত্তীর্ণ হয়েছিল। গত যুদ্ধের সময় দেখছিলাম ফ্রান্সের জেনারেল দ্য গল তার নিজের দেশ থেকে পালিয়ে এমিসার গভর্নমেণ্ট করে গভর্নমেণ্ট ইন এক্সাইল ফরাসী থেকে ইংল্যাণ্ড এসে বসেছিলেন এবং সেখানে তার পেছনে এই সমস্ত টেস্টে উত্তীর্ণ হবার তার কোন কারণই ছিল না এবং সেদিন তিনি হননি। তা সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দ্য গলের গভর্নমেণ্ট ইন এক্সাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আজকে কেন বাংলাদেশের সরকার স্বীকৃতি পাবে না। স্বীকৃতি নিশ্চয়ই তারা পাবে এবং তার জন্য সমস্ত রকমের চাপ পশ্চিম বঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের পক্ষ থেকে আমরা দেব এই বিষয়ে বিরোধী পক্ষের সঙ্গে একমত। কিন্তু আমি একটা প্রশ্ন করছি, মাননীয় সুবোধবাবু কয়েকটি তাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলেছেন। তাত্ত্বিক প্রশ্ন নিয়ে মতভেদ থাকবেই। কিন্তু আমি বলছি যে, ওপার বাংলায় যে বিরাট ঐতিহাসিক আন্দোলন চলেছে, তার সম্বন্ধে তারই দলের নেতা শ্রী শিবদাস ঘোষ মহাশয়ের বক্তৃতা আমি শুনিনি কিন্তু কাগজে পড়েছি, তাতেও স্বীকার করতে কোন দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে, ওপার বাংলায় এই যে বিরাট আন্দোলন সাড়ে সাত কোটি মানুষের হচ্ছে, এরা মার্কস পড়ে নেতৃত্বে দিচ্ছেন না, মার্কস, চেগুয়েভারা, স্ট্যালিন, লেলিন, ট্রটস্কি, মাও-সে-তুং- এদের তত্ত্বের উপর নিভৃর করে লড়াই করছে না, অতি সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক তত্ত্বকে ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে লড়াইয়ে নেমেছে। জীবন তত্ত্বের চেয়ে অনেক বড়। তত্ত্বও নিয়ে আমরা পড়ে থাকি, তাহলে আমরা দেখব জীবন তত্ত্বকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। জীবনের জন্য তত্ত্ব, তত্ত্বের জন্য জীবন নয়। মাননীয় সুবোধবাবু তিনি স্পেনের সিভিল ওয়্যারের কথা বলেছেন। স্পেনের সিভিল ওয়ারের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়েছি, আজকে এখানে স্মরণ করবার নানা কারণ আছে, আমি তাকে ধন্যবাদ দিই যে, তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধের কথা তুলেছেন। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয় স্পেনের গৃহযুদ্ধে অন্যতম বড় শিক্ষা হয় যে, সেদিন পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক স্পেনের পিছনে আসেনি। এবং সেদিন ফ্রাঙ্কো যে সমর্থন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রদ্বয়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন তারা হলেন জার্মানি ও ইটালী এবং তারই ফলে ফ্রাঙ্কো জিতেছিলেন এবং প্রজাতান্ত্রিক স্পেনের সংগ্রামী ভাইরা সেদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আর একদিক থেকে খুব ট্রাজিক হলেও স্বীকার করতে হয় যে, স্পেনের গৃহযুদ্ধের ইণ্টারন্যাশনাল ওয়ারকিং ক্লাস সেদিন এগিয়ে আসেনি। বর্গানুর মত একজন কমিনিস্ট নেতা যিনি কমিউনিস্ট ইণ্টারন্যাশনাল সেক্রেটারিয়েট ছিলেন তাঁর বিখ্যাত পুস্তক কমিউনিস্ট ইণ্টারন্যাশনালে তিনি স্বীকার করে গেছেন যে, স্পেনের গৃহযুদ্ধে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে যে পৃথিবীর কোন সমাজতান্ত্রিক কি বুর্জোয়া দেশের শ্রমিক শ্রেণী সেদিন এগিয়ে আসেনি যা তাদের আসা উচিত ছিল। অথচ একটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র তার সমস্ত শক্তি নিয়ে প্রজাতান্ত্রিক স্পেনের বিরুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিল। এখানেও তাই ঘটতে চলেছে। আজকে আমরা যদি গণতান্ত্রিক শক্তিকে সমর্থন না করি, আমরা যদি বাংলাদেশের যে বিরাট মুক্তিযুদ্ধ চলেছে তাকে সর্বতোভাবে সমর্থন না জানাই তাহলে ফ্যাসিবাদের সেখানে উদ্ভব হবে এবং আমরা ইতিহাসের কাঠগড়ায় উঠব। সুতরাং স্বীকৃতি আমাকে দিতেই হবে। তত্ত্বের কথা বলেছেন- তত্ত্বের সেই ইণ্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং ক্লাস সলিডারিটি