পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/৩৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
৩১৮
শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নঃ ভারত সরকারের এত দ্বিধা, এত ভয় কেন? বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় লিখিত নিবন্ধ দৈনিক যুগান্তর ২৩ এপ্রিল, ১৯৭১

ভারত সরকারের এত দ্বিধা, এত ভয় কেন?

-বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়

 আমাদের চোখের সামনে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এক আশ্চার্য নাকট অভিনীত হইতেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ধাপ্পাবাজী, শঠতা এবং গণতন্ত্র হত্যার বর্বরতার অবসান হইতে চলিয়াছে। জাতি-বিদ্বেষ ও সম্প্রদায় বিদ্বেষে অন্ধ রাওয়ালপিণ্ডি যে শয়তানি চক্র একদিকে ভারতবর্ষ এবং অন্যদিকে বাঙালির জাতীয় সত্ত্বা ও স্বাধীনতাকে ধ্বংস করিবার জন্য গত ২৪ বৎসর ধরিয়া নিরন্তর শত্রুতা করিয়া আসিতেছিল, আজ তার প্রতিরোধের পালা শুরু হইয়াছে। আজ ইতিহাসের ঢাকা বিপরীত দিকে ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঘাত প্রতিঘাত সম্পর্কে যারা অজ্ঞ, উদাসীন একমাত্র তারা ছাড়া আর সকলেই উপলদ্ধি করিতেছেন যে, দক্ষিণ এশিায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের তরঙ্গ শুরু হইয়াছে, আসন্ন দিনগুলিতে সেই তরঙ্গ উত্তাল হইয়া সমগ্র মহাদেশে নতুন প্লাবন ডাকিয়া আনিবে। গত ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মুজিবনগরের আম্রকুঞ্জে এক অনাড়ম্বর উৎসবের মধ্যে স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী বাংলা রাষ্ট্রের যে উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হইয়াছে, সংশয়বাদীরা তাকে তাচ্ছিল্য করিতে পারেন, অতি বুদ্ধিমানেরা তাকে উপহাস করিতে পারেন। কিন্তু অগ্নিগর্ভ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে তাকাইয়া আমরা বলিতে পারি যে, রাষ্ট্র স্বাধীনতার যে বীজ মুজিবনগরে উপ্ত হইয়াছে, আজ থেকে কাল থেকে পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে কিম্বা তার আগেই সে বিরাট মহীরুহে পরিণত হইবে। কামান, বন্দুক, ট্যাঙ্ক, বোমারুর দ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জয়যাত্রাকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী হানাদারেরা ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে না। কারণ যে স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মলাভ করিতেছে সাত কোটি বাঙালি তাকে বুকের রক্ত দিয়া রক্ষা করিবে। জননীর মমতা এবং জনকের শক্তি দিয়া এই নবজাতকে জীবনের পথে অগ্রসর করিয়া দেওয়া হইবে। এই বিষয়ে কাহারও সন্দেহ ও সংশয় থাকা উচিত নয়। এই পুরানো পৃথিবী ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে এই সেই ধ্বংস, হত্যাকাণ্ড ও রক্ত হইতে নতুন পৃথিবী জন্মলাভ করিতেছে। ভুট্টো-ইয়াহিয়া খান এবং ধনিক-বণিক-সামরিক চক্র অবশ্যই ক্ষেপা কুকুরের মতো যত্রতত্র কামড় বসাইবে, কিন্তু ইতিহাস এই ক্ষিপ্ত জানোয়ার আগাইয়া যাইবে।

 বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র পল্লীর এক নিভৃত ভূমিতে জন্মলাভ করিয়াছে। গ্রামময় বাংলাদেশের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। নিভৃত পল্লীর এই দীপশিখা ইতোমধ্যেই জ্বলন্ত মশালের রূপ ধারণ করিতে চলিয়াছে। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলার রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রিসভা এবং সশস্ত্র বাহিনী নতুন রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। দেশ-বিদেশে এই বার্তা সংবাদপত্র ও রেডিও মারফৎ ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সর্বত্র নিদারুণ ঔৎসুক্য ও উত্তেজনা। এই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম বিদেশী দূতাবাস ভারতবর্ষ-এই কলিকাতায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। গত ১৮ই এপ্রিল কলিকাতায় পাক-ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামাইয়া ফেলা হইয়াছে এবং স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের নতুন জাতীয় পতাকা উড্ডীন হইয়াছে। ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব হোসেন আলী এবং তার সহকর্মী বাঙালি অফিসারবৃন্দ নতুন বাংলা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করিয়াছেন। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলা সরকারের কূটনৈতিক প্রধানরূপে জনাব হোসেন আলী তাঁর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণের কথা ঘোষণা করিয়াছেন। ইতিপূর্বেই নয়াদিল্লীর পাকিস্তানী হাইকমিশন থেকে দুইজন বিশিষ্ট বাঙালি কুটনীতিক পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া ভারতবর্ষে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন এবং নতুন বাংলা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ